মৌর্য শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো।
মৌর্য শাসন ব্যবস্থা (Maurya Administration) ভারতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ থেকে ১৮৫ অবধি স্থায়ী ছিল এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিন্দুসার এবং অশোক মৌর্য এই সাম্রাজ্যের প্রধান শাসক ছিলেন।
মৌর্য শাসন ব্যবস্থা
কেন্দ্রীয় প্রশাসন
রাজা ও তাঁর ক্ষমতা:
মৌর্য সাম্রাজ্যে রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ শাসক এবং তাঁর হাতে ছিল সর্বোচ্চ ক্ষমতা। তিনি সমস্ত সামরিক, প্রশাসনিক ও বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। চাণক্য বা কৌটিল্যের "অর্থশাস্ত্র" অনুসারে রাজা ছিলেন জনগণের রক্ষক এবং তাঁর প্রধান কর্তব্য ছিল রাজ্যের সুরক্ষা ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
মন্ত্রী পরিষদ:
রাজাকে সহায়তা করার জন্য ছিল একটি মন্ত্রী পরিষদ, যা মন্ত্রীপরিষদ নামে পরিচিত। প্রধান মন্ত্রী ছিলেন 'মহামাত্র' এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ছিলেন যেমন - সেনাপতি, অমাত্য, সন্গৃহিত্রি (রাজস্ব মন্ত্রী) প্রভৃতি।
প্রাদেশিক প্রশাসন
প্রদেশ ও রাজ্যপাল:
মৌর্য সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল এবং প্রতিটি প্রদেশের প্রধান ছিলেন রাজ্যপাল বা 'কুমার'। রাজ্যপালরা সরাসরি রাজাকে রিপোর্ট করতেন এবং তাঁদের অধীনে ছিলেন অন্যান্য প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মচারী।
প্রাদেশিক রাজধানী:
প্রতিটি প্রদেশের একটি প্রধান রাজধানী ছিল, যেখান থেকে প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হত। উদাহরণস্বরূপ, উজ্জয়িনী এবং তক্ষশীলা ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক রাজধানী।
স্থানীয় প্রশাসন
গ্রাম প্রশাসন:
মৌর্য সাম্রাজ্যে গ্রাম প্রশাসনেরও বিশেষ গুরুত্ব ছিল। প্রতিটি গ্রামের প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন 'গ্রামিক'। গ্রামের কৃষি, রাজস্ব সংগ্রহ এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর।
নগর প্রশাসন:
নগর প্রশাসনের জন্য ছিল একটি আলাদা ব্যবস্থা। প্রতিটি নগরের প্রধান ছিলেন 'নাগরক'। নগরের রাস্তা, বাজার, স্যানিটেশন এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর।
রাজস্ব ও কর ব্যবস্থা
রাজস্ব সংগ্রহ:
মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় রাজস্ব ছিল রাজ্যের প্রধান আয়। কৃষি থেকে প্রাপ্ত কর, খনিজ সম্পদ এবং বাণিজ্য কর ছিল প্রধান রাজস্ব উৎস।
কর ব্যবস্থা:
চাষাবাদ থেকে প্রাপ্ত ফসলের এক অংশ কর হিসেবে নেওয়া হত। এছাড়াও, বণিক ও কারিগরদের থেকে বিভিন্ন ধরনের কর নেওয়া হত। রাজ্যের আয় ব্যয়ের হিসাব রাখার জন্য ছিল 'সম্পদাধ্যক্ষ'।
সামরিক ব্যবস্থা
বৃহৎ সেনাবাহিনী:
মৌর্য সাম্রাজ্যের সামরিক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও অশোক মৌর্যের আমলে একটি বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল, যাতে পদাতিক, অশ্বারোহী, হাতি বাহিনী এবং রথ ছিল।
সামরিক ব্যবস্থা:
অশোক মৌর্যের সময়কাল পর্যন্ত সামরিক অভিযান ও বিজয়াভিযান চলেছিল। কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক মৌর্য বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন এবং অহিংসার নীতি গ্রহণ করেন।
বিচার ব্যবস্থা
বিচারালয়:
মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় বিচারালয়েরও গুরুত্ব ছিল। রাজা এবং তাঁর মন্ত্রীরা বিচার করতেন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বিচারালয়ের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হত।
কৌটিল্যের "অর্থশাস্ত্র":
এই সময়ের আইন এবং প্রশাসনিক নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায় কৌটিল্যের "অর্থশাস্ত্র" থেকে, যা মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
মৌর্য শাসন ব্যবস্থার এই বিশেষত্বগুলি তাদের সাম্রাজ্যকে সুসংহত এবং উন্নত করতে সহায়তা করেছিল এবং এই শাসন ব্যবস্থা ভারতীয় ইতিহাসে একটি উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
Tags: #Ancient