ঠাণ্ডা লড়াইয়ের কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করো। এই যুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কি ছিল?

ঠাণ্ডা যুদ্ধের কারণ

ঠাণ্ডা যুদ্ধ কেন সৃষ্টি হল এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে পন্ডিতমহলে মতভেদের অন্ত নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির অনেক আগে থেকেই রাশিয়া ও আমেরিকার বিরোধকে কেন্দ্র করে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের রণক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পর্বে দেখা যায় পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরী প্রভৃতি দেশে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত হয়। এই সময় সমগ্র ইউরোপকে কিভাবে সাম্যবাদ গ্রাস করে চলেছিল তা দেখে আমেরিকা ভীত সন্ত্রস্ত হয়। তারা আশঙ্কা করে যে সোভিয়েত তার সমস্ত শক্তি ইউরোপে কেন্দ্রীভূত করতে পারে। এর ফলে সোভিয়েতের প্রতি আমেরিকাকে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করতে হয়।


এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরেক ভীতি ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব। ইউরোপের ভিন্ন স্থানে এদের প্রভাব পড়ে। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি প্রভৃতি দেশেই কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাৎসীবাদ ও ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। ইউরোপকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা থেকে রক্ষা করার একমাত্র পথ ছিল ইউরোপকে সমাজতান্ত্রিক নীতিতে পুনর্গঠন করা। এই পরিস্থিতি ছিল সাম্যবাদ প্রসারের অনুকূল। ইউরোপের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে গুরো রোজাখা জানান, ইউরোপের মধ্যে ইতালিই মূল কেন্দ্র। তাই নির্বাচনে কমিউনিস্টদের জয় হওয়ার অর্থ হল ইউরোপে তাদের অবস্থার অবনতি ঘটা।

ঠাণ্ডা যুদ্ধের কারণ

ইরান নিয়ে মতপার্থক্য

ইরান থেকে রাশিয়ার সেনা সরানো নিয়ে পশ্চিমীবর্গের সাথে ইরানের মতপার্থক্য চরমে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তি ইরান দখল করলেও উত্তর ইরান রাশিয়ার দখলে ছিল। ১৯৪২ সালে মিত্রশক্তির মধ্যে এক চুক্তি হয়। ঐ চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাশিত ছিল যে জার্মানীর আত্মসমর্পণের ছ-মাসের মধ্যে মিত্রশক্তি ইরান থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে। কিন্তু মিত্রশক্তি তা করেনি। আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেন মনে করে রাশিয়া উত্তর ইরানে বিদ্রোয়। ইন্ধন যোগাচ্ছে। এইভাবে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানী গ্রীস দখল করে। এর ফলে গ্রীসে অভ্যন্তরীণ বিরো দেখা যায়। ইংরেজ বাহিনী ১৯৪৪ সালে গ্রীসকে মুক্ত করে। রাশিয়ার সাথে চুক্তির ফলে গ্রীস ইংল্যান্ডের প্রভাবাধীন অঞ্চলে পরিণত হয়। এই সময় ইংরেজ বাহিনী গ্রীসে ফ্যাসিবাদ বিরোধ জনগণের ওপর কঠোর নীতি গ্রহণ করে। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্য ছিল গ্রীসে কমিউনিস্ট প্রভাব ক্ষুণ্ণ করা।


ইংল্যান্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীসে স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি দায়ী হয়। সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা যুদ্ধ শুরু করে। এইভাবে গ্রীসে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ ব্রিটেনের পথে। এককভাবে দমন করা সম্ভব হয়নি। ফলে তারা আমেরিকাকেও এর সাথে যুক্ত করে। গ্রীসের সরকারও আমেরিকার সাহায্য প্রার্থনা করে অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের জন্য। গ্রীস সরকারকে সামরিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। কারণ ট্রুম্যান কমিউনিস্টদের প্রভাব নষ্ট করতে চেয়েছিলেন। গ্রীসের সমস্যা সম্পর্কে গঠিত কমিশন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে এক বার্তা প্রেরণ করে যাতে তারা কমিউনিস্টদের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করার জন্য সকল প্রকার সহায়তা করে। এই কারণে ট্রুম্যান গ্রীসকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়।


তুরস্ক বিরোধ

ইরান ও গ্রীস ছাড়াও তুরস্ক বিরোধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও আমেরিকার সম্পর্ক ক্রমশ চরম অবনতির পর্যায়ে পৌঁছায়। ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে রাশিয়া-জার্মানী অনাক্রমণ চুক্তি হওয়ার পর উভয় দেশের সম্পর্ক চরম পর্যায়ে চলে যায়। রাশিয়া তুরস্কের সাথেও চুক্তি করেছিল কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রাশিয়া এই সময় তুরস্কের পূর্বে অবস্থিত প্রদেশের উপর দাবি জানায়। কৃষ্ণ সাগরের নিকটবর্তী সকল দেশের কাছে তার প্রণালী উন্মুক্ত রাখা হয় কিন্তু এই অঞ্চল দিয়ে যুদ্ধ জাহাজ চলাচলের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি করা হয়। রাশিয়া বলে বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালী ও জার্মানীর যুদ্ধ জাহাজ এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। তুরস্ক যে বেশিদিন রুশ চাপ সহ্য করতে পারবে না তা আমেরিকা বুঝতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন আমেরিকার আন্তরিক সহায়তা।


পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সমস্যা ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে। এই সমস্যা হল। এই অঞ্চলের পেট্রোলিয়াম খনিকে কেন্দ্র করে। রাশিয়ার বাকু তৈলখনি ও পারস্যর দক্ষিণাঞ্চলে অ্যাংলো-ইরানিয়ান কোম্পানীর তৈল ও ভারতের দিকে যাতায়াতের পথ রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য ছিল। আজার বাইজানসহ উত্তরের প্রদেশগুলি রুশ বাহিনীর এবং দক্ষিণাঞ্চল ইংরেজ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪২ সালে রাশিয়া, পারস্য ও ব্রিটেনের মধ্যে এক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। এখানে ঠিক হয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার ছ-মাসের মধ্যে বিদেশী সেনা প্রত্যাহার করা হবে। জার্মানীর পরাজয়ের পর পারস্য বিদেশী বাহিনী প্রত্যাহারের দাবী জানায়।


ইতিমধ্যে ১৯৪৫ খ্রীঃ আজারবাইন অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু হয়, তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই সময় রাশিয়াকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু রাশিয়া আমেরিকাকে কোনো তোয়াক্কা করেনি। এর ফলে নিরাপত্তা পরিষদে এই সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনা হয়। নিরাপত্তা পরিষদ রাশিয়াকে এপ্রিল মাসে পারস্যর সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষর করার অনুরোধ জানায়। এই চুক্তিতে রাশিয়া সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি জানায়। মে মাসে তারা সেনা সরালে এই অঞ্চলে পারস্যর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরবর্তী ক্ষেত্রে দেখা যারা দেলা সুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করে এবং নিজেদের তৈরি আণবিক বোমা সম্পর্কে রাশিয়াকে অবগত না করানোর জন্য উভয়ের মধ্যে বিরোধিতা দ্রুত প্রসারিত হয়।


ঠাণ্ডা যুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর তেমনভাবে কোনো মারাত্মক সংঘর্ষ ঘটেনি। তা হলে স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে বিশ্ব রাজনীতিতে শান্তি স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করেছিল মিত্র বাহিনী। যদি মিত্র বাহিনীর নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক সঠিকভাবে বজায় থাকত তাহলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটত না। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন ঘটেছিল। সেটা হল মিত্রশক্তির ভাঙন। রাশিয়া ও আমেরিকা ছিল এই সময়কার বিশ্ব রাজনীতির দুটি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দেশ। ইয়াল্টা সম্মেলনে রাশিয়ার স্ট্যালিন, আমেরিকার রুজভেল্ট ও ব্রিটেনের চার্চিল সমবেত হয়েছিলেন। তখন এদের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বরাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। রুজভেল্টের মৃত্যুর পর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হন ট্রুম্যান। আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি যে ট্রুম্যানের ধারণা ছিল স্ট্যালিনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে রুজভেল্ট ইয়ান্টায় অংশগ্রহণ করেন। তাই তিনি প্রথম থেকে রুশ বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন, যা স্ট্যালিনকে খুশি করেনি।


এদিকে রাশিয়ার বুকে সাম্যবাদের চূড়ান্ত বিস্তার ঘটে এবং কয়েক বছরের মধ্যেই কয়েক মিলিয়ন মানুষকে সাম্যবাদ সম্পূর্ণভাবে আকৃষ্ট করে। আমেরিকা ছিল সাম্যবাদের বিরুদ্ধে তাবা কোনোভাবেই সাম্যবাদের প্রভাবকে মেনে নিতে পারেনি। এই সময় রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদ অন্যান্য দেশকে দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলেছিল। আমেরিকা সম্পূর্ণভাবে রাশিয়াকে দমন করতে চেয়েছিল। এখান থেকেই Cold War সূচীত হল। সাম্যবাদ বিশ্বের বহু দেশকে আকৃষ্ট করে। এই সময় রাশিয়া ও পাশ্চাত্য শিবিরের মনোভাব ক্রমশ অনমনীয় হয়ে ওঠে। কেন না রাশিয়া যেহেতু সাম্যবাদের পূজারী তাই তারা পুঁজিবাদকে কঠোরভাবে সমালোচনা করল। রাশিয়ার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বহু দেশ সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য নিজেদের শক্তিশালী করে তোলে। সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে রাশিয়ার এহেন ক্রিয়াকলাপ আমেরিকা উথা পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। তাই তারাও সাম্যবাদকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য। নিয়ে নানা সামরিকতেই মেনে নিতে প্রসারে নেমে পড়ে। এর ফলে সর্বত্র যুদ্ধ প্রস্ততির মহড়া চলতে থাকে। সামরিক জোট গঠনের খেলায় ঘরে হয়ে গিয়েছিল তাই সে চেষ্টা করেছিল। অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিকে মিত্র বানাতেমা এই প্রখান থেকেই রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদ নীতি গ্রহণ করে।


ফলে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ফলে রাষ্ট্রসংঘ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই সময় সারাবিশ্বে সামরিক জোট গঠন পাশ্চাত্য শক্তির সঙ্গে বিরোধিতা চরমে ওঠে। ও যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করার এক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এই সময় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্টগুলি নিজ নিজ স্বার্থে ভেটো প্রয়োগ করে বিশ্বরাজনীতিতে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এক রাষ্ট্রসংঘকে হাতের পুতুলে পরিণত করে। আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপ রুশ বিরোধী ঐক গঠনের জন্য ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড এরকম ১২টি রাষ্ট্রকে নিয়ে Council of Europe গল্প করে। এর প্রত্যুত্তরে রাশিয়া ওয়ারশ চুক্তি স্বাক্ষর করে। এইভাবে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ফলে দূর বিরোধী শক্তি শিবিরের উৎপত্তি হয় এবং সর্বত্র যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার পরিস্থিতি তৈাই হয়। ক্রমশ সারাবিশ্ব এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়।

Tags:
Next Post Previous Post