ঠান্ডা লড়াই শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন কে? এই লড়াইয়ের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে আলোচনা করো।
১৯৪৭ খ্রিঃ মার্কিন বুদ্ধিজীবী সংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান প্রথম ঠান্ডা লড়াই কথাটি ব্যবহার করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি হিসাবে ইউরোপীয় শক্তিগুলির অধিকাংশই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কিছু শক্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ইউরোপীয় শক্তিগুলির এমত অবস্থায়, নিজেদের শক্তির উপর ভিত্তি করে দুটি নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটে। এরা হল-সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলাই বাহুল্য, ইউরোপের অন্যান্য শক্তি দুর্বল থাকায় এবং যুদ্ধোত্তর বিশ্বে টালমাটাল পরিস্থিতি থাকায় ইউরোপ তথা বিশ্ব এই দুটি শক্তির দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছিল। ইউরোপের দুর্বল দেশগুলি ক্রমেই এই দুই শক্তির সহকারী বা আশ্রিতকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ফ্যাসিবাদের বর্বরতা থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে নিজেদের আদর্শগত বৈষম্য ভুলে, একজোট হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এমনকি, যুদ্ধোত্তর বিশ্বের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়েও তাদের মধ্যে সহযোগী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে নীতিগত বৈষম্য তীব্র হয়ে ওঠে। ফলে উভয়ের সম্পর্ক ক্রমে তিক্ত হতে থাকে। যার ফলে, সোভিয়েট রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি লাভের এক অস্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত হয়।
প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলস্বরূপ সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের শক্তিগুলিকে একত্রিত করে একটি ব্লক গঠন করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিকে একত্রিত করে একটি ব্লক গঠন করে। ফলে দুটি রাষ্ট্রজোট তৈরি হয়। এই দুই জোট একে অপরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না নেমে নিজস্ব প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখতে কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। একে 'ঠান্ডা লড়াই' বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই ঠান্ডা লড়াই-এর জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বদা একটা যুদ্ধচাপের সৃষ্টি হয়। এ কারণে একে 'স্নায়ুযুদ্ধ' বলেও অভিহিত করা হয়। টয়েনবী আবার এই রাজনীতিকে 'বাইপোলার রাজনীতি' বলে অভিহিত করেছেন।
এই লড়াই প্রসারিত হয়েছে, (১) ১৯৪৫-১৯৪৯ খ্রীঃ, (২) ১৯৫০-১৯৫৩ খ্রীঃ, (৩) ১৯৫৩-৬২ খ্রীঃ এবং (৪) ১৯৬৩ খ্রীঃ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনকাল পর্যন্ত এই চারটি স্তরে বিভক্ত।
ঠাণ্ডা লড়াইয়ের বিভিন্ন পর্যায়
প্রথম পর্যায় (১৯৪৫-১৯৪৯)
ঠান্ডা লড়াই-এর পর্যায়গুলি বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনার দ্বারা আবর্তিত। এগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ্য:
(i) ইয়াল্টা সম্মেলন (১৯৪৫ খ্রীঃ):
ঠান্ডা লড়াই-এর বীজ প্রথম পরিলক্ষিত হয় ইয়ান্ট সম্মেলনের মধ্যে। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চার্চিল, রুজভেল্ট, স্টালিন মিলিয় হয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধনীতি ও যুদ্ধোত্তর দুনিয়ার পুনর্গঠন বিষয়ে আলোচনা। কিন্তু ঐ আলোচনার পর অনেকে অভিমত প্রকাশ করেন যে, সোভিয়েত রাশিয়াকে অযৌক্তিক সুবিধ দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ যুদ্ধের প্রয়োজনে যে মহাজোট স্থাপন করেছিল তা এর ফলে ভাঙার উপক্রম হয়। উভয়পক্ষ, উভয়পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করে বিবৃতির লড়াই শুরু করে এবং ঠান্ডা লড়াই-এর সূত্রপাত হয়। যদিও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন জনগণ সোভিয়েত বিরোধী হয়ে ওঠেনি।
(ii) ট্রম্যান নীতি (১৯৪৭ খ্রীঃ):
সোভিয়েত সাম্যবাদের প্রভাব ধ্বংস করার জন্য পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগোষ্ঠীর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল ট্রম্যান নীতি। বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগের পাশ্চাত্রা শক্তিগুলি রাশিয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভীত হয়ে উঠেছিল। কৃষ্ণসাগর, দার্দেনেসিল, গ্রীস ও তুরস্ককে রক্ষার উদ্দেশ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একে সোভিয়েতের দখল বলে মনে করে, তার প্রভাব খর্ব করতে উদ্যত হয়। ফলে, মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সংঘর্ষের সূচনা হয়। তবে, উভয়পক্ষই যুদ্ধনীতি গ্রহণ না করলেও শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা করতে রাজী ছিল না। মূলত স্নায়ুর লড়াই অব্যাহত থাকে।
(iii) মার্শাল প্ল্যান (১৯৪৭ খ্রীঃ):
১৯৪৭ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারী অব স্টেট জর্জ মার্শাল যুদ্ধক্লান্ত ইউরোপের পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল ইউরোপীয় শক্তিকে আহ্বান জানায় অর্থ সাহায্যের জন্য। এই সুযোগে রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী সংঘটিত হতে পারে, ইউরোপকে সাম্যবাদের হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে, এই ছিল মার্শাল প্ল্যানের উদ্দেশ্য। যদিও বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক ছিল, তবুও রাশিয়া এই প্ল্যানে সার্বিকভাবে সাড়া দেয়নি। ফলে রাশিয়ার সাথে মার্কিনদের সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হতে শুরু করে।
(iv) ন্যাটো (১৯৪৯ খ্রীঃ):
বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, লুক্সেম্বার্গ, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড ইতালী, নরওয়ে, পর্তুগালকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে যৌথ সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত করে তা উত্তর আটলান্টিক চুক্তি (North Atlantic Treaty Organisation) নামে খ্যাত। এই চুক্তি সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপকে সম্ভাব্য সোভিয়েত আক্রমণ থেকে রক্ষা করা ও গণতন্ত্র নীতির মধ্যে থেকে ইউরোপের আর্থিক ও সামরিক পুনর্গঠন। এটা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে জোটবদ্ধ না হলে সম্ভব ছিল না। ক্রমাগত সোভিয়েত বিরোধিতা ঠান্ডা লড়াইকে অন্য মাত্রা। দেয়। কারণ ন্যাটোর বিরোধিতা করে সোভিয়েত রাশিয়া কমিনফর্ম গঠন করে বার্লিন অবরোধ ঘটালে মার্কিন রুশ সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দেয়।
দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৫০-১৯৫৩)
মার্কিন-রুশ ঠান্ডা লড়াই-এর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় কোরীয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৯৫০ সালের ২৫শে জুন উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী ৩৮০ অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে আনুষ্ঠানিক কোরীয় যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। যুদ্ধে কোরিয়া জয়ী হলে রাশিয়া লাভবান হয়, কিন্তু হারলেও ক্ষতি নেই। এই উদ্দেশ্যে রাশিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ২৭শে জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে কোরিয়াকে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রস্তাব দেন জাতিপুঞ্জের সদস্যরাষ্ট্রের কাছে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রনেতা সিংম্যানরীকে সহায়তা দানের জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু চীন উত্তর কোরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না চাওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ হাজার সেনা ছাড়াও পনেরোটি রাষ্ট্রের সেনাও এতে যোগ দেয় এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৯৫ শতাংশ আর্তেল উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়।
এই সময় রাষ্ট্রপুঞ্জ বাহিনী আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। মার্কিন সেনাপতি ম্যাক আর্থার উত্তর কোরিয়া বাহিনীকে ১৫ দিনের মধ্যে ৩৮০ অক্ষরেখার বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ করে তা দখল করেন। পানমুজং দখল করে চীন সীমান্তের কাছ পর্যন্ত তা প্রসারিত হয়। ম্যাক আর্থার দুই কোরিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।
ম্যাক আর্থার তাঁর নীতিকে চীনে সম্প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে চীনের ইখুল নদীর কাছাকাছি বিভিন্ন অঞ্চলে বোমাবর্ষণ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীনা বাহিনী কোরিয়ায় প্রবেশ করে রাষ্ট্রসংঘবাহিনীকে পিছু হটিয়ে দিয়ে ১৯৫১ সালের ৪ঠা জানুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল দখল করে। কিন্তু ১৪ই মার্চ রাষ্ট্রসংঘবাহিনী পুনরায় সিওল অধিকার করে নেয়। ২৫শে মার্চ ৩৮০ অক্ষরেখা অতিক্রম করে। কিন্তু এর পরই যুদ্ধে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। সোভিয়েত বাহিনী এই যুদ্ধে চীনকে সহায়তা করেছিল। উভয় পক্ষই যুদ্ধ বিরতি চায় এবং ১৯৫৩ সালের ২৭শে জুলাই উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বিরতি ঘোষিত হলে ঠান্ডা যুদ্ধের সাময়িক বিরতি ঘটে।
তৃতীয় পর্যায় (১৯৫৩-১৯৬২ খ্রীঃ)
কোরীয় যুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়া উভয়েই উপলব্ধি করে সমগ্র বিশ্বে একে অন্য শক্তিকে ধ্বংস করে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব নয়। সোভিয়েত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে। তারা আফ্রিকা, এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে নিরপেক্ষভাবে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক দিক দিয়ে নিজেদের আদর্শ প্রচারে সচেষ্ট হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার জোট নিরপেক্ষ বান্দুং সম্মেলনে রাশিয়ার শাস্তি নীতিতে চীন কিন্তু ক্ষুন্ন হয়। তারা রাশিয়া নীতিকে 'সংশোধনবাদী' বলে নিন্দা করে। মূলত রাশিয়া-আমেরিকার নীতিতে চীনের সংযুক্তির ফলে ঠান্ডা লড়াই-এর ক্ষেত্রে এক নতুন ভারসামা সূচিত হয়। ১৯৫৬ সাল থেকেই মার্কিন বিদেশ সচিব ডালেসের কারণে ঠান্ডা লড়াই বিপর্যয়গ্রস্ত হয়। তা চলে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত। মিশর আসোয়ান বাঁধ নির্মাণে মার্কিন তরফে বাধা পেয়ে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ১৯৫৯ খ্রীঃ-এর পর রুশনেতা ক্রুয়েশ্চেভ মার্কিন সফরে এলে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়। তবে মাফিন গোয়েন্দা বিমান রুশ সীমায় প্রবেশ করলে আবার তাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। ১৯৬১ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে ঠান্ডা লড়াই পুরোমাত্রায় বহাল ছিল। রাশিয়ার সাহায্যে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মিত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুদ্ধ হয়। রুশজাহাজের কিউবায় প্রবেশ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মার্কিন নেতা জন এফ কেনেডি নৌ অবরোধ শুরু করেন। ফলে মার্কিন সংঘাতের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। রাশিয়া কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ভেঙে দিতে প্রতিশ্রুতি দিলে যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় অভিযান বন্ধ করে। কেনেডির, মৃত্যুতে ঠান্ডা লড়াই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
চতুর্থ পর্যায় (১৯৬২ খ্রীঃ-সোভিয়েতের ভাঙন)
১৯৬২ খ্রী-এর পর ঠান্ডা লড়াই -এর কেন্দ্র ছিল ভিয়েতনাম। এটি ছড়িয়ে পড়ে কম্বোডিয়াসহ পার্শ্ববর্তী কিছু দেশে। ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পৃষ্ঠপোষক ছিল চীন। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম থেকে শিক্ষা পাওয়ায় এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে দূরে থাকে। ঠান্ডা যুদ্ধ ক্রমেই স্তিমিত হতে থাকে। ১৯৭০ খ্রীঃ- এর পর রুশ-মার্কিন সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিভিন্ন চুক্তি দ্বারা তারা যৌথভাবে শান্তি রক্ষায় অগ্রসর হয়। সোভিয়েত ভাঙনের ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটে। বিশ্বে শান্তি, সহাবস্থানের নতুন আদর্শ গড়ে ওঠে।
Tags: #Europe