বঙ্গভঙ্গ বা স্বদেশী আন্দোলনের বিভিন্ন প্রবণতা বা ধারা আলোচনা কর।
ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন নিষ্কণ্টক করতে ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ঘটিয়ে বাঙালি জাতিকে হীনবল ও পঙ্গু করার চেষ্টা চালায়। এই উদ্দেশ্যে লড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রাণকেন্দ্র বাংলা প্রেসিডেন্সিকে দু টুকরো করবার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ হিসেবে শাসনতান্ত্রিক সুবিধার কথা বলা হলেও প্রকৃত উদ্দেশ্য যে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িকতা বাঙালিরা তা বুঝতে পারে। তাই জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ রোধ করার জন্য স্বদেশী আন্দোলন শুরু করেন।
স্বদেশী আন্দোলনের ধারা
স্বদেশী আন্দোলনের তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায় এগুলি হল,
- ১। স্বদেশী
- ২। বয়কট
- ৩। জাতীয় শিক্ষা
বয়কটের মাধ্যমে জাতি বিদেশি সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা শুরু করে। আর স্বদেশীর মাধ্যমে জাতি মেতে ওঠে সৃষ্টির নব আনন্দে। জাতীয় শিক্ষা হলো বিদেশী শিক্ষা বর্জন করে জাতীয় আদর্শ ও জাতীয় নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
বয়কট আন্দোলন
বয়কট কথার অর্থ "বর্জন"। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ১৩ ই জুলাই কৃষ্ণকুমার মিত্র তাঁর "সঞ্জীবনী" পত্রিকায় বয়কট বা বিদেশি সবকিছু বর্জন কে আন্দোলনের অস্ত্র রূপে প্রথম তুলে ধরেন। বয়কট অর্থে শুধুমাত্র বিলেতি বস্ত্র বা পণ্য সামগ্রী বর্জন নয়; বিলেতি চিন্তাধারা, আদব কায়দা, সমস্ত কিছুই বর্জন করার আদর্শ প্রচারিত হয়। স্বদেশী পণ্য বর্জনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলা হয়। ১৯০৫ খ্রিঃ ১৬ ই জুলাই বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাগেরহাট শহরে, ২১ শে জুলাই দিনাজপুরে, ৭ ই আগস্ট কলকাতার টাউন হলে জনসভার মাধ্যমে বয়কটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়।
ছাত্রদের ভূমিকা:
বয়কট আন্দোলনের প্রধান উৎস ছিল ছাত্রসমাজ। তাদের প্রচেষ্টায় বয়কট প্রত্যক্ষ সংগ্রামে পরিণত হয়। ছাত্ররা বিদেশী কাগজ, কলম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন করে। বিদেশি লবণ, কাপড়, চিনি, মদ ও বিদেশী পন্যাগারে সামনে তারা পিকেটিং শুরু করে। ছাত্র আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে সরকার কার্লাইল সারকুলার জারি করে।
নারী সমাজের ভূমিকা:
বাংলা নারী সমাজ ও বয়কট আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। গ্রাম গঞ্জ শহর সর্বত্রই তারা মিহিবিলিটি শাড়ি ছেড়ে তাদের মোটা তাঁতের কাপড় ব্যবহার করতে শুরু করে। কাঁচের চুড়ি, বিদেশি লবণ পরিত্যাগ করেন। তারা পর্দা ত্যাগ করে সভা, সমিতি, শোভাযাত্রা, পিকেটিং এ অংশগ্রহণ করেন।
শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকা:
কৃষক ও শ্রমিকরা বয়কট আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেনি, কিন্তু ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যে সমস্ত শ্রমিক ধর্মঘট হয় স্বদেশী নেতৃবৃন্দ তা সমর্থন করেন। এই সময়ে হাওড়ার বান কোম্পানির, কলকাতার ট্রাম কোম্পানির, সরকারি ছাপাখানা, চটকল কর্মীদের ধর্ম সংগঠিত হয়েছিল।
মুসলিম সমাজের ভূমিকা:
হিন্দু মুসলমান বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বঙ্গভঙ্গ করার চেষ্টা হলে শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায় ও অশিক্ষিত মুসলমান কৃষক সমাজ বয়কট আন্দোলনে সামিল হয়। ব্যারিস্টার আব্দুর রসুল, মৌলবি লিয়াকত হোসেন, মৌলবি আব্দুল কাসেম প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ সক্রিয় বয়কট আন্দোলনে যোগদান করেন। আব্দুল রসুল এক সভায় বলেন যে, "হিন্দু মুসলমান আমাদেরই একই মাতৃভূমি।"
স্বদেশী আন্দোলন
স্বদেশী ছিল বয়কটের পরিপূরক। স্বদেশী অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, কেবল বিদেশী দ্রব্য নয়, সর্বপ্রকার বিদেশী আদর্শের পরিবর্তে জাতীয় ভাষা, সাহিত্য শিক্ষা পদ্ধতি এবং রাজনৈতিক আদর্শ, লক্ষ্য ও প্রন্থা জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। স্বদেশী ও বয়কট হলো একই অস্ত্রের দুটি দিক। বয়কটের নেতিবাচক কর্মসূচি এবং স্বদেশী ইতিবাচক কর্মসূচি একত্রিত হয়ে "স্বদেশী আন্দোলন" এর জন্ম নেয়।
দেশীয় শিল্পের প্রতিষ্ঠা:
বয়কটের ফলে যে সংকট সৃষ্টি হয় তা দূর করতে স্বদেশীয়ানের প্রয়োজন ছিল। স্বদেশী প্রেরণায় এই সময় দেশে বহু শিল্প গড়ে ওঠতে থাকে। লক্ষণীয় হবে স্বদেশী আন্দোলনের পুনর্জাগরণ ঘটল তাঁত, রেশম, বয়ন ও অন্যান্য কুটির শিল্পে। সমস্ত দেশ জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হলো অসংখ্য কাপড়ের কল, দেশলাই, চামড়া, সাবান ইত্যাদি কারখানা। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় "বেঙ্গল কেমিক্যাল", নীলরতন সরকার প্রতিষ্ঠা করলেন "জাতীয় সাবান কারখানা"। স্বদেশীর ফলে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হলো "বঙ্গলক্ষী কটন মিল", "মোহিনী মিল"। এছাড়াও স্বদেশী শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রির জন্য শহরে এবং গ্রামে স্বদেশী দোকান গড়ে ওঠে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি
সমকালীন কবি সাহিত্যিকদের রচনা সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদের সঞ্চার করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ কবি ও গীতিকার তাদের রচনার মাধ্যমিক গভীর জাতীয়তা বাদের উন্মেষ ঘটান।
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা
বয়কট আন্দোলন বিদেশী সরকার নিয়ন্ত্রণ বিদ্যালয় ও কলেজ বয়কটের ডাক দিয়েছিল। সরকার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের উৎসাহ দান এবং বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে শচীন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কলকাতায় "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি" (১৯০৫) প্রতিষ্ঠিত হয়। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় "ডন সোসাইটি" প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে "জাতীয় শিক্ষা পরিষদ" প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পরিকল্পনা অনুসারে "বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ" প্রতিষ্ঠিত হয়। কারিগরি শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্থাপিত হয় "বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিট"।
পরিশেষে বলা যায়, জনগণের ব্যাপক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলন বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন এক স্মরণীয় অধ্যায়। ঐতিহাসিক উইল্ড ডোরান্ড এর মতে, "It was in 1905 that the India Revolution began" (১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে থেকে ভারতবর্ষে বিপ্লবের সূচনা)। গান্ধীজিও পরবর্তীকালে স্বীকার করেন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিনাশের পথপ্রদর্শক।
Tags: #Modern