মগধের অভ্যুত্থানের কারণ আলোচনা কর।
মগধের অবস্থান : এখন যেখানে দক্ষিণ বিহারের পাটনা, নালন্দা, গয়া, নাওয়াদা, ঔরঙ্গাবাদ ও জেহানাবাদ জেলা, প্রাচীন যুগে সে অঞ্চল মগধ নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক থেকে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। কালক্রমে ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিরূপে মগধের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
মগধের অভ্যুত্থানের কারণ : ভারতের রাজনীতিতে মগধের এই অভ্যুত্থানের পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল।
সুরক্ষিত নগর:
- ১। অসংখ্য পাহাড়-পর্বত, নদী নালা মগধকে ঘিরে রেখেছে। প্রকৃতির অকৃপণ সাহায্যে এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়েছে। মগধের প্রাচীন রাজধানী গিরিব্রজ বা রাজগৃহ বৈহার, বরাহ, বৃষভ, ঋষিগিরি ও চৈত্যক এই পাঁচটি পাহাড় শহরটিকে বেষ্টন করে আছে। ফলে শহরটি প্রায় দুর্ভেদ্য হয়েছে।
- ২। মগধের পরবর্তী রাজধানী পাটলিপুত্রও কম সুরক্ষিত নয়। এর একদিকে গঙ্গা, অন্যদিকে শোণ ও গণ্ডক।
উর্বর ভূমি:
মগধ নদীমাতৃক অঞ্চল। পলিমাটির প্রভাবে এখানকার ভূমি উর্বর। নদীগুলিতে সারা বছরই জল থাকে। এখানে বৃষ্টিপাতও সাধারণত নিয়মিত হয়। ফলে এই অঞ্চলে যেমন লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি কৃষিকার্যেও ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। অনিবার্যরূপে কৃষি-অর্থনীতিতে মগধ সুসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। তখনকার দিনেই এখানকার জমিতে বছরে দু'বার করে ফসল ফলানো হত। খাদ্য ও জনসম্পদের প্রাচুর্য এই অঞ্চলের উন্নতির পথ প্রশস্ত করেছিল।
প্রাকৃতিক সম্পদ:
শুধু কৃষিজ সম্পদে নয়, খনিজ সম্পদেও মগধ উন্নত ছিল। সে যুগের লোহার ও তামার খনিগুলির বেশির ভাগই মগধ ও তার পার্শ্ববর্তী ধলভূম সিংভূম অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। শুধু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নয়, যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণেও লোহা ও তামার ব্যাপক ব্যবহার ছিল।
হস্তিবাহিনী:
মগধের সামরিক শক্তির আর এক উৎস তার সুশিক্ষিত হস্তিবাহিনী। যুদ্ধের সময় শত্রু শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টির কাজে এই হস্তিবাহিনীর কোনও জুড়ি ছিল না।
নতুন অস্ত্র কৌশল:
অজাতশত্রুর সময় হতে মগধে দু'টি অভিনব অস্ত্র তৈরি হতে থাকে।
- ১। মহাশিলাকণ্টক
- 2। রথমুষল
বানিজ্য:
মগধের বাণিজ্যিক গুরুত্বও বড় কম ছিল না। স্থল ও জলপথে এই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশের ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। আন্তর ও বহির্বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
নেতৃত্ব:
সুযোগ্য নেতৃত্ব মগধের অভ্যুত্থানের আর এক কারণ। বিম্বিসার থেকে শুরু করে শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথ পর্যন্ত মগধের সকল রাজাই যে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, তা নয়। কিন্তু এঁদের অনেকেই, বিশেষ করে বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শিশুনাগ, মহাপদ্ম নন্দ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও অশোক নিঃসন্দেহে পরাক্রান্ত নরপতি ও সুদক্ষ প্রশাসক ছিলেন। রাজ্যস্থাপন বা বিশাল রাজ্য সুপরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার মতো গুণাবলি এঁদের যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। এঁরা ছাড়া মগধের অভ্যুত্থানে দু'জন রাজনীতিজ্ঞ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এঁদের একজন বর্ষকার যিনি অজাতশত্রুর মন্ত্রী ছিলেন। অন্যজন চাণক্য বা কৌটিল্য।
সংস্কৃতিক দিক:
মগধের সাংস্কৃতিক তথা সামাজিক পরিমণ্ডল তার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণকে প্রসারিত করে। দু'টি সংস্কৃতির মিলনস্থলে মগধের অবস্থিতি। এর পশ্চিমে আর্য সংস্কৃতির দুর্গ পাঞ্জাব ও উত্তর- প্রদেশ, পূর্বে অনার্য সংস্কৃতির কেন্দ্র নিম্ন গাঙ্গেয় অববাহিকা মগধে এই দুই সংস্কৃতির মিলন ঘটায় তার চিত্তবৃত্তি মধ্যদেশের তুলনায় উদার ও উন্নত হয়েছে।
ধর্মীয় দিক:
গোড়া ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিধিনিষেধের কঠোরতা এখানে শিথিল হয়েছে। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের ব্যাপক প্রসারে জনমানস অনেকখানি পরিচ্ছন্ন ও সংস্কারমুক্ত হয়েছে। ব্রাহ্মণ এখানে স্বচ্ছন্দে ব্রাত্যের সঙ্গে মিশেছেন ক্ষুদ্রকন্যা রাজার ছন। বৈশ্য ও যবন আপন যোগ্যতায় উচ্চ পদ লাভ করেছেন। অন্তঃপুরে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। নাপিতপুত্র নিজ বাহুবলে সিংহাসন অধিকার করেছেন। ব্রাহ্মণ সানন্দে ক্ষত্রিয় গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। মগধের এই উদার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণকে প্রসারিত করেছে, তাকে এক বিশাল সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র হতে প্রেরণা জুগিয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরূপে মগধের আত্মপ্রকাশের পিছনে আরও একটি বড় প্রেরণা কাজ করেছিল। সেই প্রেরণাটি হল, এক, অখণ্ড ভারত গড়ার প্রেরণা। অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতভূমিতে দু'টি বিপরীতমুখী শক্তি কাজ করে চলেছে। এঁদের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদ, অন্যটি অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মরু-জঙ্গল ভারতকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করেছে, বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদকে চূর্ণ করে সারা ভারতকে একতাবদ্ধ করার একটা প্রয়াস বরাবরই সক্রিয় ছিল। মগধের পরাক্রান্ত রাজারা সেই চেষ্টায় সামিল হয়েছিলেন।
Tags: #মগধ