ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্মনীতি আলোচনা কর।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্মনীতি
ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্মনীতি প্রসঙ্গে উলেমা ও অভিজাতদের প্রভাব, ফিরোজ শাহের উলেমানীতির কারণ, ফিরোজের উলেমা নির্ভরতার কারণ, ধর্মান্ধতা, ধর্মান্ধ আচরণ, কর ব্যবস্থার নমনীয়তা ও রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানবো।
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্মনীতি আধুনিক গবেষকদের কাছে একটি বিতর্কিত বিষয়। ডঃ আর. সি. মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিক ফিরোজ শাহকে ধর্মান্ধ, গোঁড়া সুলতানরূপে ব্যাখ্যা করেছেন।
ডঃ আর. সি. মজুমদারের মতে,
ফিরোজ তাঁর নিজ ধর্ম বিশ্বাসকে রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে যুক্ত করেন। এজন্য তাঁর শাসনব্যবস্থা একটি ধর্মাশ্রিত রাজতন্ত্র ছিল। অপর দিকে অন্যান্য গবেষকরা ফিরোজ শাহকে ধর্মান্ধ সুলতান বলে মনে করেন নি। ফিরোজের ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাস অবশ্যই সুন্নী ধর্মীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
উলেমা ও অভিজাতদের প্রভাব
সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর মত ফিরোজ শাহ ঘোর সামরিক স্বৈরাচারী ছিলেন না। তাঁর সামরিক প্রতিভা আদপেই ছিল না। সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের মত তিনি জ্ঞানী ও যুক্তিবাদীও ছিলেন না। কাজেই পূর্ববর্তী দুই সুলতান যেভাবে উলেমা শ্রেণী ও অভিজাত শ্রেণীর ওপর নির্ভর না করে শাসনদণ্ড পরিচালনা করেন, ফিরোজ শাহের সেই যোগ্যতা ছিল না।
ফিরোজ শাহের উলেমানীতির কারণ
- (১) ফিরোজ তার সিংহাসনের ওপর অধিকার মজবুত করার জন্য উলেমা শ্রেণীর সহায়তা নেন। বরণীর মতে, সিন্ধু থেকে দিল্লী আসার পথে তিনি মুসলিম বুদ্ধিজীবী, উলেমা প্রভৃতির জন্য ভূমি দানের আদেশ দেন। তিনি খলিফার প্রতি তার আনুগত্য জানান।
- (২) তিনি শরিয়ত অনুযায়ী নিজেকে রাষ্ট্রের অছি বা ন্যাসরক্ষক বলে ভাবতেন। খলিফা ফিরোজের সিংহাসনের দাবীকে স্বীকৃতি দিলে, ফিরোজ সেই স্বীকৃতি পত্রকে এক মূল্যবান দলিল বলে গণ্য করতেন। তিনি নিজেকে খলিফার নায়েব হিসেবে ঘোষণা করেন।
ফিরোজের উলেমা নির্ভরতার প্রস্তুতি
- (১) উলেমাদের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন অথবা খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় ফিরোজ তাঁর পূর্ববর্তী সুলতানদের নীতি থেকে হয়ত বিচ্যুত হন। কিন্তু তার জন্য তাকে ধর্মান্ধ বলা যাবে না। ফিরোজ তাঁর সিংহাসনের দাবীকে জোরালো করার জন্যই উলেমাদের সহায়তা নেন এবং খলিফার পরোয়ানা যোগাড় করেন।
- (২) মহম্মদের বিরুদ্ধে উলেমাশ্রেণীর বিরোধিতার ফলে মহম্মদের শোচনীয় পরিণাম তিনি প্রত্যক্ষ করেন। কাজেই তিনি উলেমাদের সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় নীতি নেন। উলেমাদের প্রভাবে তিনি সক্রিয়ভাবে ধর্মান্ধতা দেখান এই কথা মনে করার কারণ নেই।
ধর্মান্ধতা
ফিরোজের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধতার প্রমাণ স্বরূপ বলা হয় যে,
- (১) তিনি হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর চাপান।
- (২) তিনি পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির ও কাংড়ায় জ্বালামুখী মন্দির ভাঙেন।
- (৩) তিনি উলেমাদের দেওয়া শরিয়তের ব্যাখ্যা মেনে নেন। সেই অনুযায়ী তিনি আইন বিধি রচনা করেন।
- (৪) আলাউদ্দিন ও মহম্মদ খামসের ৩/৪ ভাগ নিজে নিতেন ১/৪ ভাগ সেনাদলকে দিতেন। ফিরোজ শরিয়তের বিধান মেনে নিয়ে নিজে খামসের ১/৪ ভাগ নেন এবং ৩/৪ ভাগ সেনাদলকে দেন।
- (৫) তিনি শরিয়ত অনুযায়ী “সিয়াস্ত” চালু করেন। অপরাধীদের অঙ্গচ্ছেদ ও মৃত্যু দণ্ড নিষিদ্ধ করেন। বিশেষভাবে মুসলিমদের প্রতি তিনি এই নির্যাতন ও শাস্তি নিষিদ্ধ করেন।
- (৬) ১৩৭৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে তার রাজত্বের শেষ ১৫ বছর তিনি ধর্মান্ধতার পরিচয় দেন। তিনি দিল্লীর মুসলিম মহিলাদের পর্দার অন্তরালে থাকতে বাধ্য করেন।
- (৭) তিনি হিন্দু ও শিয়াদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিষ্ঠুরতা দেখান। মাহাদি সম্প্রদায়ের মুসলিমদেরও তিনি দমন করেন। গোঁড়া সুন্নী মত ছাড়া অন্য কোনো ইসলামীয় মতকে তিনি সহ্য করতেন না।
ধর্মান্ধতার বিচার
ফিরোজের বিরুদ্ধে উপরোক্ত ধর্মান্ধতার অভিযোগগুলি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করা দরকার। যেমন –
- (১) জিজিয়া কর ফিরোজ শাহ নতুন করে প্রবর্তন করেন নি। তার পূর্ববর্তী সুলতানদের আমলেও জিজিয়া কর ছিল। ডঃ ত্রিপাঠীর মতে, জিজিয়া কর আদায়ে বহু অসুবিধা থাকায় তার পূর্ববর্তী সুলতানরা এই কর আদায়ে উৎসাহ দেখান নি।
- (২) আলাউদ্দিন ও মহম্মদের আমলের চড়া হারে ভূমি রাজস্ব যেহেতু ফিরোজ রদ করেন এবং ২৪ টি উপরি কর রদ করেন, সেহেতু তিনি রাজস্বের ঘাটতি দূর করার জন্য জিজিয়া আদায় করতেন। জিজিয়াকে ঠিক বৈষম্যমূলক ধর্মীয় কর হিসেবে দেখা উচিত নয়।
- (৩) ডঃ নিজামীর মতে জিজিয়া ছিল ভূমি-রাজস্ব ছাড়া আর একটি অতিরিক্ত কর। ইসলামীয় আইনে ধর্মাবলম্বীদের পুরাতন মন্দির ও উপাসনার স্থান রক্ষা করার কথা আছে। ফিরোজ শাহ তাঁর সাম্রাজ্যের মধ্যে কোনো হিন্দুমন্দির ধ্বংস করেন বলে বলা যায় নি।
- (৪) সাম্রাজ্যের বাইরের অঞ্চল ছিল “দার-উল-হারাম”, যা উড়িষ্যা ও কাংড়া। ফিরোজ ইসলামীয় আইন অনুসারে সাম্রাজ্যের বাইরের বিধর্মীদের প্রতি কঠোরতা দেখান। ফিরোজ এই কারণে পুরীর জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করেন।
- (৫) তিনি জ্বালামুখী মন্দির থেকে হিন্দু জ্যোতিষ ও দর্শনের যে ১৩টি পাণ্ডুলিপি পান, সেগুলি ধ্বংস না করে ফার্সীতে অনুবাদ করান। এই অনুবাদগুচ্ছের নাম ছিল “দলাইল-ই-ফিরোজশাহী।
ধর্মান্ধ আচরণ
- (১) তার ৩৮ বছর শাসনকালের মধ্যে শেষ ১৫ বছর ছাড়া ফিরোজ শাহের ধর্মান্ধ আচরণের কোনো নিদর্শন নেই। তার বার্ধক্য দশা ও মানসিক দুর্বলতা বশত তিনি তাঁর রাজত্বের শেষদিকে ধর্মনীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্য হারান।
- (২) ফুতহা-ই-ফিরোজ শাহীতে ফিরোজ নিজেই তার ধর্মীয় বিধানগুলির উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাঁর গোটা রাজত্বকালকে এই শেষের দিকের ধর্মান্ধ নীতি দিয়ে বিচার করা উচিত হবে না।
আফিফের মন্তব্য,
ঐতিহাসিক আফিফ বলেছেন যে, ফিরোজ দিল্লীর ব্রাহ্মণ অধিবাসীদের কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করেন৷ কিন্তু যদি ফিরোজ ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি নিয়ে ব্রাহ্মণদের ওপর জিজিয়া কর চাপান, তবে কেবলমাত্র দিল্লীর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে তিনি কেন বেছে নেন, আফিফ তার কারণ ব্যাখ্যা করেননি।
কর ব্যবস্থার নমনীয়তা
ফিরোজ শরিয়ত-সম্মত ৪ প্রকার কর আদায় ও অন্যান্য বাড়তি কর রহিত করে অন্যায় কিছু করেন নি। তিনি এর দ্বারা আলাউদ্দিন ও মহম্মদের আমলের চড়া হারে ভূমি-রাজস্ব লাঘব করেন। সাধারণ প্রজা এর ফলে উপকৃত হয়। যদিও তিনি সেচকর আদায় করতেন, তিনি কোনো ক্ষেত্রে তার পূর্ববর্তী সুলতানদের মত চড়াহারে ভূমি-রাজস্ব ধার্য করেন নি।
রাজনৈতিক প্রয়ােজনিয়তা
আসলে ফিরোজ শাহ তার সিংহাসনকে মজবুত করার জন্য উলেমা শ্রেণীর সহায়তা নেন। এজন্য তাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উলেমাদের দাবী মেনে আইন রচনা করতে হয়। এটি ছিল তার রাজনৈতিক প্রয়োজন।
পরিশেষে বলা যায় যে, উলেমানের প্রভাবে তিনি ব্যাপক ধর্মান্ধ নীতি নেন একথা বলা যায় না। তিনি ছিলেন জনদরদী ও মানবতাবাদী শাসক। সাধারণ প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তিনি বহু কাজ করেন।
(FAQ) ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্মনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
- ১. নগরকোটের জ্বালামুখী মন্দির লুন্ঠন করে কোন সুলতান?
ফিরোজ শাহ তুঘলক।
- ২. কোন সময়ে ফিরোজ শাহ তুঘলক ধর্মান্ধ হয়ে ওঠেন?
জীবনের শেষ ১৫ বছর।
- ৩. কোন সুলতান সেচকর আদায় করতেন?
ফিরোজ শাহ তুঘলক।
Tags:
#Class 7
#Medieval