ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ আলোচনা কর।

ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ আলোচনা কর।

ফ্রান্সের আর্থিক দুরবস্থা বিপ্লবের জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ আর্থিক দিক থেকে ফ্রান্স ছিল এমন একটি দেশ, যার রাজকোষ ছিল অর্থশূন্য, এবং রাজস্ব-ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিমূলক।

শূন্য রাজকোষ

রাজন্যবর্গের যুদ্ধনীতি, বিলাসিতা, অমিতব্যয়িতা, ব্যয়সংকোচে সরকারের অনীহা,মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও খাদ্যাভাব ফ্রান্সকে সর্বনাশের শেষ সীমায় দাঁড় করিয়ে দেয়। অধ্যাপক গুডউইন বলেন যে, প্রাক্-বিপ্লব ফরাসি সরকারের প্রধান ত্রুটিই হল ভ্রান্ত অর্থনীতি।

চতুর্দশ ও পঞ্চদশ লুইয়ের রাজত্বকাল

চতুর্দশ লুইয়ের আমলে (১৬৪৩-১৭১৫ খ্রিঃ) ফ্রান্স একাধিক ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যা রাষ্ট্রের আর্থিক শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। পঞ্চদশ লুইয়ের আমলে (১৭১৫-১৭৭৪ খ্রিঃ) এই ব্যয়ভার বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় নি।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান

  • (১) ষোড়শ লুই (১৭৭৪-১৭৯৩ খ্রিঃ) যুদ্ধে নামার উদ্যোগ গ্রহণ করলে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রী তুর্গো তাঁকে সাবধান করে দেন এই বলে যে, “আর একটি কামান দাগলে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাবে।
  • (২) তা সত্ত্বেও তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করে অকাতরে অর্থব্যয় করায় ফ্রান্সের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে ফ্রান্সের ব্যয় হয় ১৮০ থেকে ২০০ কোটি লিভ্র। উঁচু সুদের বিনিময়ে এই অর্থ বাজার থেকে ঋণ হিসেবে সংগৃহীত হয়।

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রের ব্যয়

  • (১) অধ্যাপক গুডউইন-এর লেখা থেকে জানা যায় যে, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রের ব্যয় হয় ৬৩ কোটি লিভ্র। এর মধ্যে ৩১ কোটি ৮০ লক্ষ লিভ্র ব্যয় হয়েছিল কেবলমাত্র ঋণের সুদ হিসেবে।
  • (২) ফ্রান্সের রাজারা এইভাবে ঋণের অর্থে যুদ্ধ পরিচালনা এবং বিলাস ব্যসন ও জাঁকজমক করতেন। এছাড়া, তিনজন ফরাসি রাজার বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতা প্রবাদে পরিণত হয়েছিল।
  • (৩) ঐতিহাসিক গুডউইন বলেন যে, ভার্সাইয়ের রাজসভায় ১৮ হাজার কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। এদের মধ্যে ১৬ হাজার কর্মচারী ছিল কেবল রাজপ্রাসাদের কাজের জন্য।
  • (৪) রানির খাস চাকরের সংখ্যা ছিল ৫০০। এছাড়া, রানি নিত্যনতুন পোশাক ও ভোজসভার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। এই সবই চলত ঋণের অর্থে এবং এর জন্য নিয়মিত উচ্চহারে সুদ দিতে হত।
  • (৫) অধ্যাপক গুডউইন বলেন যে, ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে অর্থনৈতিক সমস্যার মূল কথা হল বিশাল পরিমাণ ব্যয়ের বোঝা লাঘবে সরকারের অক্ষমতা।

বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা

  • (১) ফরাসি সমাজ ‘অধিকারভোগী’ ও ‘অধিকারবিহীন’—এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। অধিকারভোগী শ্রেণি ফ্রান্সের অধিকাংশ ভূ-সম্পত্তির মালিক ছিল এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত, কিন্তু এজন্য তারা রাষ্ট্রকে কোনও কর দিত না।
  • (২) দারিদ্র্য-জর্জরিত কৃষকদের সমস্ত করের বোঝা বহন করতে হত। ফ্রান্সের সমগ্র রাজস্বের শতকরা ৯৬ শতাংশ ‘অধিকারবিহীন’ তৃতীয় সম্প্রদায়কে দিতে হত, বাকি মাত্র ৪ ভাগ বহন করত প্রথম ও দ্বিতীয় সম্প্রদায়।
  • (৩) ঐতিহাসিক লাব্রুজ-এর মতে, “অষ্টাদশ শতকে ফরাসি কৃষকরা ছিল সর্বাপেক্ষা শোষিত।”রাষ্ট্র, জমিদার ও গির্জা তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের কর আদায় করত। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে ছিল ‘টেইল’ বা ভূমিকর, ‘ক্যাপিটেশন’ বা উৎপাদন কর, চিটিংয়েছে’ বা আয়কর।
  • (৪) তাছাড়া ছিল ‘গ্যাবেলা’ বা লবণকর, ‘টাইদ’ বা ধর্মকর, ‘এইডস্’ ব মদ, তামাক প্রভৃতির উপর ধার্য কর এবং আরও নানা ধরনের সামন্তকর। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য তাদের বাধ্যতামূলকভাবে বেগার খাটতে হত। এই শ্রমকরের নাম ছিল ‘কর্ডি”।
  • (৫) এইভাবে সমস্ত করের বোঝা মিটিয়ে কৃষকদের হাতে থাকত তার আয়ের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ, যা দিয়ে তার গ্রাসাচ্ছাদন অসম্ভব ছিল। এই অন্যায় ও অযৌক্তিক কর আদায়ে প্রচণ্ড কঠোরতা অবলম্বন করা হত।
  • (৬) সরকারের অভ্যন্তরীণ শুল্ক নীতি ও শিল্প নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা মাল চলাচল ও অবাধ বাণিজ্যের প্রতিবন্ধক ছিল। শুল্ক বিভাগের কর্মচারীরা নানাভাবে অর্থ আত্মসাৎ করত ও বণিকদের উপর অত্যাচার চালাত। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটত এবং রাজকোষে অর্থ জমা পড়ত না।
  • (৭) এইসব কারণে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তৎকালীন ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির যাদুঘর’ (‘Museum of Exonomic Errors’) বলে অভিহিত করেছেন।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়

  • (১) এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল জনস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির অভিশাপ। সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরেই ফ্রান্সের জনসংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তা আড়াই কোটিতে পৌঁছায়।
  • (২) ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রাস্ফীতির দরুন দ্রব্যমূল্য প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পায়।১৭৮৮ থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্যহানি হলে খাদ্যশস্যের দাম ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায় কিন্তু মজুরি বৃদ্ধি পায় মাত্র ২২ শতাংশ।
  • (৩) খাদ্যশস্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য সাধারণ শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।ফ্রান্সের নানা স্থানে ‘রুটির দাঙ্গা শুরু হয় এবং বুভুক্ষু মানুষ খাদ্যের সন্ধানেগ্ৰাম ত্যাগ করে শহরে চলে আসতে থাকে।
  • (৪) এই শোচনীয় আর্থিক সংকট থাকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ষোড়শ লুই পরপর চারজন অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেন, কিন্তু প্রথম দুই শ্রেণি কোনওরকম কর দিতে রাজি ছিল না।
  • (৫) অর্থ সংগ্রহের আর কোনও উপায় না থাকায় ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেল বা ফরাসি জাতীয় সভার অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন এবংএর ফলে বিপ্লব শুরু হয়। তাই বলা হয় যে, বিপ্লবের মূলে ছিল আর্থিক কারণ।

পরিশেষে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবের কারণগুলির গুরুত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত নন। মোর্স স্টিফেন্স বলেন এই বিপ্লবের কারণ ছিল প্রধানত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক – দার্শনিক বা সামাজিক নয়।লেফেভর অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণের উপরেই বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।ঐতিহাসিক মিশেল বলেন যে, পুরনো ব্যবস্থার নিপীড়নের সঙ্গে দুঃসহ দারিদ্র বিপ্লবেরদ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।
Tags:
Next Post Previous Post