মধ্যযুগের গোড়াপত্তন সম্পর্কে হেনরি পিরেনের মত আলোচনা কর।
পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত সময়ে ইউরোপের সৃষ্টির রহস্য রোমান এবং জার্মান ক্ল্যাসিকাল ও বার্বারিয়ান সংস্কৃতির বহু বিচিত্র উপাদানের স্বার্থক মিলনের মধ্যে নিহিত ছিল। এর সঙ্গে যোগসাধক হিসাবে কাজ করেছিল খ্রিস্টধর্ম। সপ্তম এবং অষ্টম শতকে মুসলমান শক্তির বিস্তারের অভিঘাতে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের জীবনে যে পরিবর্তন ঘনিয়ে আসে, তা মধ্যযুগের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। মধ্যযুগীয় সভ্যতার উদ্ভবের পিছনে কার্যকর জটিল গতিপ্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন ঐতিহাসিক হেনরি পিরেন।
পিরেনের মতে, ধ্রুপদী রোমান সাম্রাজ্যের অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল প্রধানত ভূমধ্যসাগরের বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে। মেরোভিঞ্জিয় যুগ ছিল পূর্ববর্তী ধ্রুপদী রোমান যুগের পরবর্তী অধ্যায় মাত্র। তার মতে, আরব মুসলমানদের ভূমধ্যসাগর অভিযানের পর ভূমধ্যসাগর দ্বিখন্ডিত হয়, বাণিজ্য লুপ্ত হয় এবং ইউরোপ মূলত গ্রামিণ কৃষি-অর্থনীতি ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ফিরে যায়।
পিরেন বলেছেন, ৬৭০-৬৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিমদের দ্বারা টিউনিশিয়া অধিকারই ছিল ভূমধ্যসাগরের বাণিজ্য ধ্বংস হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনি বলেছেন, নুবিয়ার সোনার খনিগুলি থেকে যে সোনা কনস্ট্যান্টিনোপলে আসত তার উপর ভিত্তি করেই ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্য চলত। কিন্তু ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে মিশর মুসলমানদের দখলে চলে গেলে পূর্ব-রোমান সাম্রাজ্য এই সোনার যোগান থেকে বঞ্চিত হয়। এর সঙ্গে আরব মুসলমানদের দ্বারা টিউনিশিয়া দখল ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে সঙ্কট আনে। বাণিজ্যের বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নগর ও শহরের পৌর আইন-কানুন এবং মুদ্রার অবক্ষয় ঘটে। পিরেন সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, প্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরে মুসলমানদের অভিযান এবং বিজয় মধ্যযুগীয় ইউরোপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সামন্ত্রতন্ত্রের উদ্ভব ঘটায়। তিনি আরো বলেছেন, হজরত মহম্মদের উত্থান ছাড়া গলে সামন্তপ্রথার চূড়ান্ত প্রতীক শার্লেমানের সাম্রাজ্য গড়ে উঠত না।
হেনরি পিরেন দৃঢ় ভাষায় ঘোষণা করেছেন, প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রিয় ঐক্য, অর্থনৈতিক বিকাশ, এমনকি শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব নির্ভর করত ভূমধ্যসাগরের উপর। তাঁর মতে, চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর বর্বর আক্রমণে নয়, সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের শক্তির অসামান্য বিস্তারের ফলে পশ্চিম ইউরোপের ভূমধ্যসাগর-কেন্দ্রিক জীবনযাত্রা শিথিল হয়ে পড়ে। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমাধ্যের মধ্যেই পারস্য সাম্রাজ্য আরব সেনাবাহিনীর হস্তগত হয়। সিরিয়া, মিশর ও পারস্য সাম্রাজ্য বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যচ্যুত হয়। ৭১১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে স্পেনে আরব সৈন্য প্রবেশ করে। ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমে চার্লস মার্টেলের সেনাবাহিনীর কাছে তুরের যুদ্ধে পরাজয়ের আগে পর্যন্ত আরবদের বিজয় অভিযান অব্যাহত থাকে। তবে ইসলামের সম্প্রসারণের শক্তি নির্বাপিত হলেও ইতিমধ্যেই তাদের সামরিক সাফল্য ইউরোপের ধ্রুপদী ইতিহাসের অবসান ঘটায়। মুসলিম অধিকৃত স্থানগুলিতের মহম্মদের ধর্ম প্রবর্তিত হয়, রোমান আইনের স্থান দখল করে মুসলিম আইন। গ্রিক ও ল্যাটিনের স্থান গ্রহণ করে আরবী ভাষা। ভূমধ্যসাগর যেন ‘মুসলমান-হ্রদ'-এ পরিণত হয়। ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করে ইউরোপের দুই প্রান্তের মধ্যে গড়ে ওঠা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভূমধ্যসাগরের উপকূলভাগের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি আরবদের হস্তগত হলে বহিবিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিম ইউরোপ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তার কেন্দ্রবিন্দু ভুমধ্যসাগর থেকে ইউরোপে স্থানন্তরিত হয়। রোমের স্থান দখল করে আখেন। ফ্রাঙ্ক জাতি ইতিহাসের পাদপ্রদীপে উঠে আসে। ক্যারোলিঞ্জিয় ফ্রাঙ্করা পশ্চিম ইউরোপে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পিরেন প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ইসলামের বিজয় ইউরোপে এইভাবে ধ্রুপদী রোমান যুগের অবসান ঘটিয়ে মধ্যযুগের সূচনা ঘটায়।
পিরেন আরো বলেন যে, ইসলামের বিজয়ে ভূমধ্যসাগরের উপর কর্তৃত্বের অবসান, বাজারের সীমাবদ্ধতা প্রভৃতির ফলে কারোলিঞ্জিয় যুগে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রোমান সাম্রাজ্যের সামগ্রিক উদারতার পরিবর্তে সঙ্কীর্ণতা লক্ষ্য করা যায়। মুষ্টিমেয় যাজকদের আধিপত্য, আঞ্চলিক ভাষাগুলির উত্থান, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অপমৃত্যু প্রভৃতি মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্যগুলি 'অর্থনৈতিক পশ্চাদ্গতির অপ্রতিরোধনীয় পরিণতি। এই সুযোগ গ্রহণ করেন সম্রাট শার্লেমান।
পিরেনের তত্ত্বে দুটি ভাগ রয়েছে –
- ১. প্রথমে তিনি ধ্রুপদি ঐতিহ্যের অবসানের জন্য ইসলামের সম্প্রসারণকে চিহ্নিত করেছেন৷
- ২. দ্বিতীয় ভাগে শার্লেমানের উত্থানের পিছনে এইরূপ অবস্থাকে দায়ি করেছেন।
তার তত্ত্বের মূল কথা হল, রোমান ধ্রুপদি যুগের অবসান ইউরোপে মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্যগুলির অবসান ঘটায়, যা ইসলামের সম্প্রসারণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পরিণতি।
Tags:
#Europe