আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কারগুলির পরিচয় দাও।

আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কারগুলির পরিচয় দাও।

আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন দিল্লির সুলতানির সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। কেবল তাঁর সামরিক অভিযানের জন্যই নয়, কয়েকটি সুপরিকল্পিত ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে তিনি নিজেকে স্মরণীয় করে রেখেছেন।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ

ঐতিহাসিক বারনি তাঁর 'তারিখ-ই-ফিরোজসাহি' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, বিশাল সেনাবাহিনী প্রতিপালনের উদ্দেশ্যেই আলাউদ্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেন । এই সেনাবাহিনীর বেতন মেটানোর কারণে রাজকোষে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। এজন্য তিনি কর দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং বাজারে সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেঁধে দেন। সমস্ত হিন্দু ও মুসলমান বণিকদের পঞ্জীভূত হতে হত এবং তাদের পণ্যসম্ভার বদারুণ দরজার ভিতরে সরাই আদল নামে খোলা জায়গায় বিক্রির জন্য আনতে হত। ধনী ও সম্ভ্রান্ত মুলতানি ব্যবসায়ীদের রাজকোষ থেকে অর্থ অগ্রিম দেওয়া হত যাতে তারা প্রচুর পরিমাণে দ্রব্য সামগ্রী কিনতে পারেন এবং বাজারে আনতে পারেন। বাজার পরিদর্শন ও তদারকির জন্য ‘দেওয়ান-ই-রিয়াসৎ’ ও ‘সাহানা-ই মাণ্ডি' নামে দুজন কর্মচারী নিযুক্ত হন। তারা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতেন। শিল্পের প্রতিও আলাউদ্দিনের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। কুতুব মসজিদের কাছে তিনি একটি খুব সুন্দর প্রবেশদ্বার নির্মাণ করিয়েছিলেন। এটি ‘আলাই দরওয়াজা' নামে পরিচিত।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বারনি তার পরবর্তী গ্রন্থ ‘ফতেপা-ই-জাহান্দরি'তে উল্লেখ করেছেন যে, জনসাধারণের মঙ্গল কামনাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। কবি আমির খসরু তাঁর ‘খাজা-ইন-উলফতু’-তে মন্তব্য করেছেন যে, জনসাধারণের কল্যাণই সম্রাটের উদ্দেশ্য ছিল। হাবিব, নিজামি ও ড. ইরফান হাবিব উল্লেখ করেছেন যে, কোথাও আলাউদ্দিন খলজি বলেননি যে, সেনাবাহিনীর সুবিধার জন্যই তিনি জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেন। আলাউদ্দিন খলজির সঙ্গে হামিদউদ্দিনের যে কথোপকথন হয়েছিল তাতে দেখা যায় যে, আলাউদ্দিন জনসাধারণের মঙ্গলকাঙ্ক্ষী ছিলেন। ঐতিহাসিক লেনপুলের মতে, মূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলে সাধারণ জনগণ বিশেষভাবে উপকৃত হয়। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মতো আলাউদ্দিন বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের সাফল্য নির্ভর করে সমস্ত শ্রেণির জনগণকে স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে।

কৃষি ও সরকারের যোগাযোগ স্থাপন 

আলাউদ্দিনই প্রথম সুলতান যিনি কৃষকদের সঙ্গে সরকারের প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন করেন এবং কৃষকদের ঠিক কী পরিমাণ অর্থ দেয় তাও স্থির করেন। তা ছাড়া স্থানীয় প্রধানেরা অর্থাৎ মুকদ্দম, খুৎ, চৌধুরি ইত্যাদিরা কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি সরকারের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধস্থাপন করেন। ‘ইকতা’বলতে মোটামুটি জায়গিরকে বোঝানো হত। যারা কর আদায় করতেন অর্থাৎ ‘আমিন’, ‘মুকদ্দম’, ‘খু’ ইত্যাদির ওপর কঠোর দৃষ্টি রাখা হয়েছিল যাতে তাঁরা ক্ষমতার অপব্যবহার না করতে পারেন। আলাউদ্দিনের ব্যবস্থার ফলে রাজস্ব বৃদ্ধি পায়, রাজস্ব আদায়কারীদের অবস্থান অবনতি হয় ও কৃষকরাও করভারে জর্জরিত হয়। সমসাময়িক কবি আমির খসরু কৃষকদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বলেছেন, “রাজমুকুটের প্রতিটি মুক্তা দরিদ্র কৃষকদের অশ্রুসিক্ত চক্ষু থেকে ঝরিত জমাট রক্তবিন্দু।”
Tags:
Next Post Previous Post