উনিশ শতকের মুসলিম সমাজ সংস্কার আন্দোলন (আলিগড় আন্দোলন) | অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায়
মুসলিম সমাজে সংস্কার প্রক্রিয়া : আলিগড় আন্দোলন
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে মুসলমান সমাজেও বিভিন্ন সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় মহামেডান লিটেরারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা তারই প্রমাণ মুসলমান সংস্কারকদের মধ্যে স্যর সৈয়দ আহমদ খান ছিলেন সবথেকে অগ্রগণ্য । চাকরির সুবাদে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্যর সৈয়দ। ফলে মুসলমান সমাজেও ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চা জনপ্রিয় করার জন্য উদ্যোগ নেন তিনি। তার পাশাপাশি বিভিন্ন বিজ্ঞানের বই উর্দু ভাষায় অনুবাদ করা হতে থাকে। আধুনিক যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে কোরানকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন সৈয়দ আহমদ। পুরোনো প্রথা ও যুক্তিহীন অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সওয়াল করেছিলেন তিনি। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন স্যর সৈয়দ। মুসলমান ছাত্র-শিক্ষকদের পাশাপাশি বেশ কিছু হিন্দু ছাত্র ও শিক্ষক ঐ কলেজে পড়াশুনার চর্চা করতেন।
তবে মুসলমান সমাজে সবাই স্যর সৈয়দের সংস্কারগুলি সমর্থন করেনি। পাশাপাশি স্যর সৈয়দ আহমদের সংস্কার প্রক্রিয়াগুলি সীমিত চরিত্রের ছিল। বিরাট সংখ্যক গরিব মুসলমানদের উপর ঐসব সংস্কারের কোনো প্রভাব পড়েনি। মূলত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলমানরাই ঐ সংস্কারগুলি গ্রহণ করেছিলেন।
অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর
আলিগড় কলেজের ইংরেজি অধ্যক্ষ কে ছিলেন?
স্যার সৈয়দ আহমদ খান
আলিগড় কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ কে ছিলেন?
থিওডোর বেক
আলিগড় আন্দোলন বলতে কি বোঝ?
স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করে তিনি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, যুক্তিবাদ, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে তিনি যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হলেন থিয়োডর বেক। উচ্চশ্রেণীর মধ্যে ছিল৷
আলিগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্য কি ছিল?
আলিগড় আন্দোলন জনক সৈয়দ আহম্মদ খান পরিচালিত। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল
- ১। মুসলিম সমাজের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ঘটানো।
- ২। মুসলিম সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক চিন্তার বিকাশ ঘটানো।
- ৩। ইংরেজদের প্রতি প্রীতিপূর্ণ মানসিকতা তৈরী।
- ৪। ইংরেজ সরকার প্রদত্ত চাকরিকে সাদরে গ্রহণ।
- ৫। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের অগ্রগতি ঘটানো।
সৈয়দ আহম্মদ খান প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি সংস্থার নাম লেখো ?
সৈয়দ আহম্মদ খান প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি সংস্থার নাম হল—
- ১। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে 'সায়েন্টিফিক সোসাইটি'।
- ২। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কমিটি যার 'অ্যাডভার্সমেন্ট অফ লার্নিং অ্যান্ড দি মহামেডানস্ অফ ইন্ডিয়া'।
- ৩। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (আলিগড় কলেজ)
- ৪। ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন' প্রভৃতি৷
সৈয়দ আহম্মদ খাঁ রচিত একটি পুস্তিকার নাম লেখো।
সৈয়দ আহম্মদ খাঁ রচিত একটি পুস্তিকার নাম হল— "The Loyal Muhammedans of India".
এই পুস্তিকার প্রধান বিষয়বস্তু হল – বিপদের দিনে ভারতে ব্রিটিশদের প্রকৃত বন্ধু হল মুসলমান সম্প্রদায়। মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অল্প। বেশিরভাগ মুসলিম ছিল ব্রিটিশদের অনুগত।
দ্বিজাতি তত্ত্ব কি?
সৈয়দ আহম্মদ খাঁ প্রচার করেন যে, হিন্দু ও মুসলমান পরস্পর পৃথক দুটি জাতি এবং তাদের স্বার্থ পরস্পর বিরোধী, তাদের সহাবস্থান সম্ভব নয়। ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম নেয়।
মুসলিম সমাজের জাগরণে আলিগড় আন্দোলনের অবদান কি ছিল?
- ১ ৷ এই আন্দোলন হতাশাগ্রস্ত পিছিয়েপড়া মুসলিম সমাজে নতুন আশা আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার করে।
- ২। মুসলিম সমাজের মধ্যে উদ্দীপনার সঞ্চার করে মুসলিম সমাজকে কু-সংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে।
- ৩। এই আন্দোলন মুসলিম সমাজের মধ্যে পাশ্চাত্যের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তাদের মধ্যে আধুনিকতা এনে দেয়।
- ৪। মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ ও জাতীয়তাবাদের সঞ্চার ঘটে।
- ৫। এই কলেজ থেকে পরবর্তীকালে বহু কৃতি মুসলিম সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব হয়।
কবে কে সহবাস সম্মতি আইন পাশ করেন ?
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে স্যার অ্যান্ড্রু স্কোবল-এর উদ্যোগে সহবাস সম্মতি বিলটি পাশ করা হয়। যাতে বিবাহের বয়স দশ থেকে বারো করা হয়।
আলিগড় আন্দোলনের কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
আলিগড় আন্দোলনের কয়েকজন নেতার নাম হল—চিরাগ আলি, উর্দু কবি আলতাফ হোসেন আলি, মৌলানা শিবালি নোমানি, শিক্ষাবিদ খুদা বক্স প্রমুখ।
আলিগড় আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল?
আলিগড় আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাগুলি হল
- ১। গোঁড়া মৌলবি ও মোল্লারা সৈয়দ আহমদের ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারের বিরোধিতা করে।
- ২। এই আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ দরিদ্র মুসলিমদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
- ৩। উত্তরপ্রদেশের কিছু জমিদার, উচ্চবিত্ত মানুষ ও চাকুরিজীবীর স্বার্থই ছিল এই আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি।
- ৪। বৃহত্তর ভারতীয় স্বার্থের কথা এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ চিন্তা করেননি।