পিরামিড কি? পিরামিড কেন তৈরি করা হত? মিশরের তিনটি উল্লেখযোগ্য পিরামিড
প্রাচীন কালে মিশরের ফ্যারাও এবং সম্ভ্রান্তদের মৃতদেহের সমাধিস্থলে নির্মিত স্মৃতিসৌধকে বলা হত পিরামিড। মিশরের পিরামিডগুলি তৈরি করা হয়েছিল নানা কারণে।
পিরামিড কি?
প্রাচীন মিশরের অন্যতম স্থাপত্যকীর্তি হল পিরামিড। ফ্যারাও জোসের আমলে স্থাপত্যশিল্পী ইমহোটেপ সর্বপ্রথম পিরামিড তৈরির কৌশল আবিষ্কার করেন। ফ্যারাও জোসের সমাধিস্থলের ওপর তিনি প্রথম মিশরের পিরামিডটি তৈরি করেন। মিশরের সর্ববৃহৎ পিরামিডটি হল খুফুর পিরামিড। মিশরের কায়রোর কাছে গিজেতে এটি তৈরি করান ফ্যারাও খিয়পস (খুফু)। অন্যান্য কয়েকটি বিখ্যাত পিরামিড হল নেফরা পিরামিড, মেনকুরা পিরামিড, টুটেনখামেনের পিরামিড ইত্যাদি ৷
পিরামিড তৈরির কারণসমূহ
মৃতদেহের সংরক্ষণ : 👉
মিশরবাসী মৃত্যুকেই জীবনের শেষ বলে মনে করত না। তারা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পরেও মানুষের আর একটা জীবন রয়েছে। তাই তারা মৃতদেহকে মমি করে কাঠের বাক্সে ভরে সমাধিস্থ করত। প্রাচীন মিশরে কেবলমাত্র ফ্যারাও এবং ধনী অভিজাত শ্রেণির লোকেরাই মৃত্যুর পর মৃতদেহকে সংরক্ষণের অধিকারী ছিল । সমাজের নিম্নশ্রেণির লোকেদের এই অধিকার ছিল না। সাধারণত রাজা বা অভিজাতদের জীবদ্দশাতেই এগুলি তৈরি করে রাখা হত। যাতে মৃত্যুর পরেই মৃতদেহকে সেখানে স্থানান্তর করা যায়। ধনী পুরোহিত শ্রেণির তত্ত্বাবধানে তৈরি হত পিরামিডগুলি।
আত্মার সংরক্ষণ : 👉
প্রাচীন মিশরবাসী বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর পর আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায় না। আত্মা দেহের মধ্যেই অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকে। তাই শরীরকে সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা মনে করত। তাদের ধারণায় আত্মাকে ইহলোকের দেহেই বাস করার সুযোগ দেওয়া উচিত। তারা মনে করত মানুষের প্রথম সত্তা হল অশরীরী আত্মা। যেটি হল 'বা' এবং সেই আত্মার জীবনিশক্তি, বা দ্বিতীয় সত্তা হল ‘কা’। মৃতদেহ সংরক্ষণ করলে ‘বা’ এবং ‘কা’ সেই মৃতদেহতে প্রবেশ করে। ফলে মৃতদেহটি পুনরুজ্জীবিত হয়। এই ধারণা থেকেই মৃতদেহগুলিকে মমি হিসেবে সংরক্ষণ করা হত। আর সেই সমাধিস্থলে পিরামিড নির্মিত হত।
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ : 👉
প্রাচীন মিশরের ফ্যারাও এবং অভিজাতগণ পিরামিড তৈরির মধ্যে দিয়ে নিজেদের সমাধিস্তম্ভ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। খুফু, টুটেনখামেন, নেফরা, মেনকুরা প্রমুখ ফ্যারাও নিজেদের স্মৃতিরক্ষার্থেই পিরামিডগুলি তৈরি করেছিলেন। প্রকৃত অর্থে ফ্যারাও এবং অভিজাতরা চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরেও তাদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে। মিশরে পুরোনো যুগের রাজত্বের সূচনা থেকেই ফ্যারাওরা প্রচুর পিরামিড তৈরি করতে শুরু করেন। নীলনদের তীরে ৪০০০ বছর পূর্বের স্মৃতিস্তম্ভগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি আজও টিকে রয়েছে।
রক্ষণশীল মানসিকতা : 👉
প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা ছিল রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন। তারা মনে করত মানুষের দেহ থেকে শুরু করে সব কিছুই প্রকৃতির দান। প্রকৃতির দানকে কখনোই নষ্ট করা উচিত নয়। এই মনোভাব থেকেই তারা মৃতদেহকে রক্ষার জন্য মমি বানাত। প্রথমদিকে তারা এই মমিকে সাধারণভাবেই সমাহিত করত। মাটির নীচে শায়িত মমির পাশে তারা বহু ধনরত্ন এবং তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখত। কিন্তু অচিরেই সেগুলি লুঠ হয়ে যেত। তাই মৃত দেহগুলি অর্থাৎ মমিকে সুরক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই তৈরি হল পিরামিড।
মহিমা প্রচার : 👉
মিশরের ফ্যারাওগণ পিরামিড তৈরির মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিজেদের মহিমা প্রচার করতে চেয়েছিলেন। মেনেস, খুফু, টুটেনখামেন, দ্বিতীয় রামেসিস, নেফরা সহ বিভিন্ন ফ্যারাও এই লক্ষ্য নিয়েই বড়ো বড়ো পিরামিড তৈরি করে গেছেন। প্রকাণ্ড পিরামিডগুলির ভিতরেও সুপ্রশস্ত রাজকীয় পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছিল।
উল্লেখযোগ্য তিনটি পিরামিড
প্রথম পিরামিড : 👉
মিশরের প্রথম পিরামিডটি তৈরি হয়েছিল ফ্যারাও জোস-এর সমাধির উপর। স্থাপত্যশিল্পী ইমহোটেপের নেতৃত্বে এটি তৈরি হয়। তিনকোণবিশিষ্ট এই পিরামিডটির উচ্চতা হল প্রায় ৬০ মিটার। ধাপে ধাপে নির্মিত হয়েছিল বলে এটিকে ধাপ পিরামিডও বলা হয়।
খুফুর পিরামিড : 👉
মিশরে চতুর্থ রাজবংশের দ্বিতীয় ফ্যারাও ছিলেন খুফু বা খিয়পস (Cheops)। মিশরের কায়রো শহরের কাছে গিজে-তে তিনি নিজের নামে সর্ববৃহৎ এই পিরামিডটি তৈরি করান। প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক ২০ বছর ধরে এই পিরামিডটি তৈরি করেন। এই পিরামিডটির উচ্চতা হল ৪৫০ ফুট, পরিধি হল ৭০০ ফুট। খুফুর পিরামিডটির প্রবেশদ্বারের উচ্চতা মাটি থেকে প্রায় ৪৯ ফুট। ২০ লক্ষ পাথর খণ্ড দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল।
টুটেনখামেন-এর সমাধি : 👉
মিশরের কিশোর ফ্যারাও ছিলেন টুটেনখামেন। ঐতিহাসিকদের অনুমান, তিনি মাত্র ১৭ (মতভেদে ১৯) বছর বয়সে মারা যান। ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার ‘ভ্যালি অফ দ্য কিংস' অঞ্চলে টুটেনখামেনের সমাধিস্থল আবিষ্কার করেন। জানা যায় তিনি ছিলেন মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের একজন ফ্যারাও। টুটেনখামেন-এর মমিটির মুখে সোনার মুখোশ লাগানো ছিল, তাই তাকে 'সোনামুখো ফ্যারাও' বলা হত। এ ছাড়াও তাঁর গোটা দেহে সোনা দিয়ে প্রায় ১৪৩ ধরনের সামগ্রী সাজানো ছিল।
পিরামিডের গঠন
একটি পিরামিড হল একটি জ্যামিতিক আকৃতি যা একটি বহুভুজ ভিত্তি এবং ত্রিভুজাকার মুখ দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যা একটি সাধারণ শীর্ষবিন্দুতে একত্রিত হয় যাকে শীর্ষ বা পিরামিডের শীর্ষবিন্দু বলা হয়। এখানে পিরামিড সম্পর্কে কিছু মূল বিষয় রয়েছে:
1. সংজ্ঞা: একটি পিরামিড হল একটি ত্রিমাত্রিক কঠিন যার একটি বহুভুজ ভিত্তি এবং ত্রিভুজাকার মুখগুলি একক বিন্দুতে মিলিত হয়।
2. বেস: একটি পিরামিডের ভিত্তি হল একটি বহুভুজ, যা ত্রিভুজ, বর্গক্ষেত্র, পঞ্চভুজ ইত্যাদির মতো যেকোনো আকৃতির হতে পারে। ভিত্তিটি পিরামিডের ধরন নির্ধারণ করে, যেমন একটি ত্রিভুজাকার পিরামিড, বর্গাকার পিরামিড বা পঞ্চভুজ পিরামিড।
3. মুখ: একটি পিরামিডের ত্রিভুজাকার মুখ রয়েছে যা ভিতরের দিকে তির্যক এবং শীর্ষে একত্রিত হয়। একটি পিরামিডের মুখের সংখ্যা সর্বদা এর ভিত্তির বাহুর সংখ্যার চেয়ে এক বেশি।
4. এপেক্স: পিরামিডের শীর্ষস্থান হল শীর্ষস্থান যেখানে সমস্ত ত্রিভুজাকার মুখ মিলিত হয়। এটি শীর্ষবিন্দু বা পিরামিডের অগ্রভাগ নামেও পরিচিত।
5. প্রান্ত: একটি পিরামিডের প্রান্তগুলি ত্রিভুজাকার মুখগুলির ছেদ দ্বারা গঠিত রেখার অংশ। একটি পিরামিডের প্রান্তের সংখ্যা ভিত্তির প্রান্তের সংখ্যা এবং ভিত্তির বাহুর সংখ্যার সমষ্টির সমান।
6. উচ্চতা: একটি পিরামিডের উচ্চতা হল ভিত্তি থেকে শীর্ষের লম্ব দূরত্ব। এটি শীর্ষ এবং বেসের কেন্দ্রের মধ্যে দূরত্ব হিসাবেও সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
7. আয়তন: একটি পিরামিডের আয়তন সূত্রটি ব্যবহার করে গণনা করা যেতে পারে: আয়তন = (1/3) * ভিত্তি এলাকা * উচ্চতা। বেস এরিয়া হল বহুভুজ ভিত্তির ক্ষেত্র।
8. পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল: একটি পিরামিডের পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল তার সমস্ত মুখের ক্ষেত্রফল যোগ করে গণনা করা যেতে পারে। এটি সূত্র ব্যবহার করেও পাওয়া যেতে পারে: সারফেস এরিয়া = বেস এরিয়া + (1/2) * বেসের পরিধি * তির্যক উচ্চতা। তির্যক উচ্চতা হল ত্রিভুজাকার মুখগুলির একটির উচ্চতা।
9. উদাহরণ: কিছু সুপরিচিত পিরামিডের মধ্যে রয়েছে মিশরের গিজার গ্রেট পিরামিড, যা প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি এবং মেক্সিকোতে টিওটিহুয়াকানে সূর্যের পিরামিড।
পিরামিডগুলি বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা দ্বারা স্মারক কাঠামো, সমাধি বা ধর্মীয় স্থান হিসাবে তৈরি করা হয়েছে এবং সেগুলি অধ্যয়ন এবং অন্বেষণের একটি আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে চলেছে।