হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা বা নাগরিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর৷
ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় হরপ্পা সভ্যতার আবিস্কার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা৷ এটি ছিল প্রায় সারে ৪০০০ হাজার পুরনো নগর কেন্দ্রীক সভ্যতা৷ প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে মেশোপটেমিয়া ও সুমেরীয় সভ্যতার সমসাময়িক ছিল এই সভ্যতা৷ কোন লিখিত দলিল না পাওয়া যাওয়ায় হরপ্পা সভ্যতা সম্পর্কে জানতে আমরা পুরোপুরি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের উপর নির্ভর করি৷
নগরকেন্দ্রীক সভ্যতা
সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রীক সভ্যতা৷ প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে হরপ্পার প্রধান কেন্দ্র গুলি যথা,
হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, রূপার, কালিবঙ্গান, লোথাল প্রভৃতি স্থানে উন্নত মানের নগর জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়৷ এই সব নগর গুলি অবস্থানগত দূরত্ব যথেষ্ট হলেও নগরপরিকল্পনার গঠনরীতি ও জীবনযাত্রার উপকরনের মধ্যে যথেষ্ট মিলছিল৷
প্রধান নগর
নগরপরিকল্পনা ছিল হরপ্পা সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ৷ হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো প্রভৃতি প্রধান শহর গুলি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল-
- ১. দূর্গ অঞ্চল: মনে করা হয় এখানে শাসক শ্রেণীর মানুষ বসবাস করত৷ হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবঙ্গানে একটি করে দূর্গের ধ্বংস স্তুপ পাওয়া গিয়েছে৷
- ২. বসত বাড়ি: এখানে অন্যান্য শহরবাসী বসবাস করত৷ মনে করা হয় সাধারণ শ্রমজীবি ও কৃষিজীবি মানুষ বসবাস করত৷
মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা প্রতিটি শহরের নির্মাণ কার্য সম্পূর্ণ হয়েছিল পরিকল্পনা মাফিক৷ এই নির্মাণ শৈলী প্রকৃতই বিষ্ময় সৃষ্টি করে৷
স্নানাগার
মহেঞ্জোদারো নির্মাণ শৈলীর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল বৃহৎ স্নানাগার৷ যার আয়তন ছিল ১৮০ × ১০৮ ফুট এবং স্নানের জলাশয়ের আয়তন ছিল ৩৯ × ২৩ ফুট, এবং এর গভীরতা ছিল ৮ ফুট৷ জলাশয় থেকে নোংড়া জল বাহির ও পরিষ্কার জল প্রবেশের ব্যবস্থা ছিল৷ জলাধারে ওঠা নামার জন্য সিরি ছিল এবং চারপাশে ছোট ছোট ঘর ছিল৷ ডঃ রামশরন শর্মার মতে, "স্নানের পর পোষাক পরিবর্তনের জন্য ঘর গুলি ব্যবহার হত"৷ মার্টিমার হুইলার মনে করেন যে, "ধর্মীয় উদ্দেশ্যে স্নানাগারটি ব্যবহৃত হত"৷
শস্যাগার
নগর পরিকল্পনার আরো এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হল হরপ্পায় অবস্থিতি একটি বৃহৎ শস্যাগার৷ এর আয়তন ছিল দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০০ ফুট ও প্রস্থে ১৫০ ফুট৷ শস্যাগার সমলগ্ন বিশাল চাতালে শস্য ঝাড়াই করা হত৷ এর পাশাপাশি কিছু ছোট ঘরের নিদর্শন পাওয়া গেছে; মনে করা হয় এগুলিতে শস্য ঝাড়াই-এর সাথে যুক্ত শ্রমিকরা বসবাস করত৷ এর প্রসঙ্গে হুইলার বলেন যে, "খ্রিস্ট পূর্ব পঞ্চম শতকের পূর্বে এধরনের বিশাল শস্যাগার পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায়নি"৷
রাস্তাঘাট
মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার এক বর্গ মাইল জুড়ে প্রধান শহর গুলি বিন্যস্ত ছিল৷ রাস্তা গুলি ছিল প্রশস্ত ও উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরাল ভাবে বিন্যস্ত৷ রাস্তাঘাটের এই বিন্যাস সচেতনভাবে নগর পরিকল্পনার সাক্ষ্য বহন করে৷ যা সমসাময়িক মিশরে অজ্ঞাত ছিল৷
উন্নত প্রয়ঃ প্রনালী
নগর গুলির প্রয়ঃ প্রনালী ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট উন্নত৷ প্রতিটি বাড়ি থেকে জল নালা দিয়ে বাহিত হয়ে বড় রাস্তার প্রধান নালায় এসে পড়ত৷ নর্দমা গুলি ছিল ইটের তৈরি ও ঢাকনা দেওয়া৷ এগুলি পরিস্কার করার জন্য ম্যানহোল থাকত৷ ঐতিহাসিক A. L. Basham তাঁর 'The Wonder That Was India' গ্রন্থের ২৬ তম পাতায় বলেছেন যে, "No other ancient civilization until that of the Roman has no efficient a system of drains".
পৌর শাসন
ঐতিহাসিকদের মতে নগরের নিয়ম কানুন পরিচালনার দায়িত্ব ছিল পৌর প্রশাসনের উপর৷ পৌর শাসন ছিল কেন্দ্রীভূত ও সুদৃঢ় ৷ রাস্তাঘাট, গৃহ নির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কঠোর শৃঙ্খলা পালন করা হত৷ স্যার জন মার্শাল সিন্ধুর নগর বিন্যাসকে আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য নগরের সঙ্গে তুলনা করেছেন৷ ডঃ আর. এস. শর্মা বলেছেন, "No urban complex of Harappa magnitude has been discovered so far".
পরিশেষে বলা যায়, হরপ্পার এই সব বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে পরবর্তী কালে আরো অনেক উন্নত নগর গড়ে উঠেছিল৷ এস. পি গুপ্ত তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, "সিন্ধু সভ্যতা পূর্ণ বিকশিত বৈদিক সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ দিকে প্রতিধ্বনী করে৷