সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? স্বাধীনতার পর ভারতে গৃহীত বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ গুলি কি কি ছিল?


সমাজতন্ত্রের ধারনা

মার্কসবাদী আদর্শে সমাজতন্ত্রকে শ্রেষ্ঠ শাসনকাঠামো বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা দেওয়া হয়।

  • ১. অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্র বলতে বোঝায়, সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
  • ২. কোনো সমাজে যে ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজের সবাই মিলে উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত সামগ্রী সবাই মিলে ভোগ করে, তা সমাজতন্ত্র নামে পরিচিত।
  • ৩. অন্যভাবে বলা যায়, শোষণমুক্ত সমাজের নাম হল সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এই ব্যবস্থায় কারও কোনো ব্যক্তিগত Mail সম্পত্তি থাকে না, যার দ্বারা অন্যের শ্রমকে শোষণ করা যায়। এক কথায়, শ্রেণিহীন সমাজের নাম হল সমাজতান্ত্রিক সমাজ। সমাজতন্ত্রে কোনো শোষক-শোষিত, ধনী-গরিবের শ্রেণিভেদ থাকে না। রাশিয়ায় ভি.আই লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়৷ ১৯৪৯ সালে মাও সে তুঙের নেতৃত্বে চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়৷ 
সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? স্বাধীনতার পর ভারতে গৃহীত বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ গুলি কি কি ছিল?



স্বাধীন ভারতে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ

স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই কংগ্রেসসহ ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার দ্বারা আকৃষ্ট হন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ভারতের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে সমাজতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। 

বামপন্থী আন্দোলন: 

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও  চরমপন্থী সমাজতান্ত্রিক দলগুলি ভূস্বামী ও জমিদারদের বিরুদ্ধে দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে। তাদের উদ্যোগে বাংলার কৃষকরা ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে ১৯৪০-এর দশকে তেভাগা আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনকারী ভাগচাষীরা উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশের পরিবর্তে ২/৩ অংশ দাবি করে । এ ছাড়া দাক্ষিণাত্যে হায়দ্রাবাদের তেলেঙ্গানায় স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী ১ বছর ধরে জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ চলে, যা তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এসব বিদ্রোহ কৃষক শোষণের অবসানে সরকারকে সচেতন করে।

মিশ্র অর্থনীতি: 

প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর 'Discovery of India' গ্রন্থে স্বাধীন ভারতে তাঁর প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর আদর্শ ছিল যে—
  • ১) সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা বজায় থাকবে, 
  • ২) ভারী শিল্পে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অস্তিত্ব থাকবে,
  • ৩) সমবায়ভিত্তিক গ্রামীণ ও ক্ষুদ্রশিল্পকে উৎসাহিত করা হবে। 

এভাবে নেহরু সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগের অস্তিত্ব বজায় রেখে ভারতে 'মিশ্র অর্থনীতি' গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এই ধরনের অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা বিদ্যমান।

জমিদারি প্রথার অবসান: 

স্বাধীনতা লাভের সময় দেখা যায় যে, গ্রামের বেশিরভাগ জমিই মুষ্টিমেয় কিছু ধনী ভূস্বামীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং দেশের বিপুল সংখ্যক কৃষক ছিল ভূমিহীন। এই বৈষম্য দূর করা সরকারের আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কংগ্রেস কৃষি সংস্কার কমিটি (১৯৪৯ খ্রি.) ঘোষণা করে যে, স্বাধীন ভারতের কৃষিব্যবস্থায় কোনো মধ্যস্বত্বভোগীর স্থান নেই। জমির মালিকানা' থাকবে কৃষকের হাতে। অর্থাৎ এই কমিটি 'লাঙল যার জমি তার ' নীতির কথা ঘোষণা করে প্রকৃত কৃষকের হাতে জমির মালিকানা প্রদানের কথা বলে। সেই অনুসারে সরকার ১৯৫১ ও ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘোষণা করে। জমিদাররা প্রতিরোধের পথে গেলেও ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অধিকাংশ রাজ্যে জমিদারি প্রথার অবসান ঘটে এবং কৃষকদের হাতে জমির মালিকানা আসে।

জমির উর্ধ্বসীমা: 

জমিদারি প্রথার অবসানের পর প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নাগপুর অধিবেশনে কংগ্রেস জানায় যে, প্রতিটি রাজ্য সরকারকে জমির ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিতে হবে। এরপর ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্য জমির ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে জমির ঊর্ধ্বসীমা স্থির হয় ২৫ একর। এর ফলে বিভিন্ন রাজ্যে জমিদারদের অধীনস্থ জমি না ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। বিনোবা ভাবে, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সর্বোদয় আন্দোলনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ভূমিবণ্টনের উদ্যোগ নেন।

রাজন্য ভাতার বিলোপ : 

ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের পর বেশ কিছু দেশীয় রাজ্য ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করে। প্রথমদিকে দেশীয় রাজ্যগুলির রাজাদের রাজন্য ভাতা দেওয়া হলেও কিছুকাল পর সরকার রাজন্য ভাতার বিলোপ ঘোষণা করে। ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পায়।

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র: 

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারতকে একটি ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র' (Sovereign Socialist Secular Democratic Republic) বলে উল্লেখ করা হয়। এভাবে ভারতবর্ষ একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়।

জাতীয়করণ: 

সরকার বিভিন্ন বিমা ও কিছু বৃহৎ ব্যাংককে জাতীয়করণ করে। ফলে ব্যক্তিগত উদ্যোগের স্থলে জাতীয় উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়। এর দ্বারা দেশের জনগণের হাতে প্রত্যক্ষ সুফল আসার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

কর আরোপ: 

ধনীদের আয়, সম্পদ ও আর্থিক লেনদেনের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করে সরকার জাতীয় আয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পাশাপাশি নেহরুর লক্ষ্য ছিল, দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের করের আওতার বাইরে রাখা ।

অনগ্রসরদের জন্য ব্যবস্থা: 

সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল পিছিয়ে-পড়া তপশিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলিকে সমাজের মূলস্রোতের সমপর্যায়ে উন্নীত করা। এজন্য ভারতের সংবিধানে এসব পিছিয়ে-পড়া সম্প্রদায়গুলির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা ছাড়া অস্পৃশ্যতার মতো অসামাজিক বিষয়গুলিকে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করে এসব জাতিকে মর্যাদাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কমিউনিস্ট সরকারের ভূমিকা: 

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করে ১৯৬০-এর দশকে কেরালায় এবং ১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করে। এই সরকার নিজ নিজ রাজ্যে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করে।

Tags:
Next Post Previous Post