সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব (The achievements of Samudra Gupta)
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে অসাধারণ প্রতিভাবান বিজেতা হিসেবে সমুদ্রগুপ্তের পরিচয় স্বীকৃত। তিনি নিজ বাহুবলে গাঙ্গেয় উপত্যকার একটি আঞ্চলিক রাজ্যকে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। উত্তর-ভারতের প্রবল নাগশক্তিকে পরাজিত করে তিনি যেমন গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় আধিপত্য রাখেন, দাক্ষিণাত্য অভিযানে তিনি তা অপেক্ষা অনেক বেশী পারদর্শিতা দেখান। দক্ষিণের যুদ্ধে প্রবল পল্লব শক্তিকে পরাস্ত করা তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দেয় সন্দেহ নেই।
রাজ্য জয়
কোন কোন ঐতিহাসিক "সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্বকে", খাটো করে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বলেন যে, দক্ষিণের রাজারা সমুদ্রগুপ্তের অধিরাজত্ব মেনে চলতেন এমন কোন প্রমাণ নেই। তাঁরা তাঁর প্রতি আনুগত্য জানান; এর বেশী কিছু নয়। সমুদ্রগুপ্ত পশ্চিম ভারতের শক রাজাদের সঙ্গে সঙ্ঘাত এড়িয়ে যান। পশ্চিম পাঞ্জাব ছিল তাঁর সাম্রাজ্যসীমার বাইরে। সুতরাং তাঁর বিজয়কে যত বড় করে দেখান হয়, প্রকৃতপক্ষে তিনি তত পরাক্রান্ত ছিলেন না।
ভারতের বৃহত্তম অংশে অধিকার স্থাপন
সমুদ্রগুপ্ত সমগ্র ভারত জয় করেন নি একথা যেমন সত্য, তেমন তিনি যতটা স্থান জয় করেন তা কম ছিল না। হরিষেণ হয়ত সভাকবি হিসাবে সমুদ্রগুপ্তের পরাক্রমের কথা কিছু বাড়িয়ে বলেছেন। কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে তিনি বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন এতে সন্দেহ নেই। ডঃ গয়ালের মতে, দক্ষিণে দারুণ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সমুদ্রগুপ্ত সফলতা পান। তাছাড়া দাক্ষিণাত্যে প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপনের অবাস্তব চেষ্টা না করে তিনি তাঁর সার্বভৌমত্ব স্থাপন করে দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। ডঃ গয়ালের মতে, দক্ষিণ হতে নিয়মিত কর লাভ করে তিনি সম্পদশালী হন এবং তার সাহায্যে এক পরাক্রান্ত বাহিনী গঠন করেন। দক্ষিণে স্বায়ত্ব শাসন দান করে তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখান। কারণ এই দূরবর্তী রাজ্যকে প্রত্যক্ষ শাসনে রাখা সম্ভব ছিল না।
রাজ্যজয় নীতির বিচার
সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য নীতিকে স্মিথ নিছক আগ্রাসী নীতি বলেছেন। পররাজ্য গ্রাস করাই তাঁর প্রধান কর্তব্য ছিল বলে স্মিথ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ডঃ রায়চৌধুরী এই মত খণ্ডন করেছেন। সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় নীতির পশ্চাতে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের আদর্শ কাজ করেছিল বলে তিনি মনে করেন। সমুদ্রগুপ্ত তাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারা শাস্ত্রীয় রাজচক্রবর্তীর আদর্শকে রূপায়িত করেন। তাছাড়া সমুদ্রগুপ্ত তাঁর শাসনব্যবস্থায় স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসন নীতিকে মেনে নেন। এর ফলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ও ঔপজাতিক স্বাতন্ত্র্য্য রক্ষা পায়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত্তি এর দ্বারা মজবুত হয়।
ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় নীতিকে অনেকে ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার জয়ের প্রতীক বলেছেন। তাঁর আমলে যে গুপ্ত রেনেসাঁসের সূচনা হয় তা ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং ক্ষত্রিয় রাজাদের রাজনৈতিক অধিকারের ওপর নির্ভরশীল। সমুদ্রগুপ্তের আমলে যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির জাগরণ ঘটে তা ছিল উচ্চশ্রেণীর লোকের মধ্যে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে এজন্যে সমুদ্রগুপ্ত ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ দায়ী ছিলেন বলা যায় না। শুঙ্গ যুগ হতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং সংস্কৃত ভাষা উচ্চশ্রেণীর ভাষারূপে পরিগণিত হয়েছিল। কুষাণ যুগেও সংস্কৃত ভাষা প্রাকৃত ভাষাকে কোণঠাসা করেছিল। সুতরাং সমুদ্রগুপ্ত হঠাৎ ব্রাহ্মণ্যধর্মকে তুলে ধরেন বা সংস্কৃত ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন একথা বলা চলে না।
ব্যক্তিগত চরিত্র ও গুণাগুণ
সমুদ্রগুপ্ত নিজে বিবিধ গুণের অধিকারী ছিলেন। হরিষেণের মতে, তিনি কাব্য রচনা, সঙ্গীত, শিল্প এবং রণবিদ্যা সকল গুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর বীণাবাদনরত মূর্তিযুক্ত মুদ্রা তাঁর সঙ্গীতপ্রিয়তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাঁর রণপাণ্ডিত্যের জন্যে স্মিথ তাঁকে “ভারতের নেপোলিয়ন” বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি ভারতীয় দেবদেবীর মূর্তিযুক্ত উন্নত মানের স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করে তাঁর শিল্পবোধের পরিচয় দিয়েছেন। ডঃ রায়চৌধুরী তাঁকে মৌর্য সম্রাট অশোকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অশোক ধর্মবিজয় দ্বারা প্রধান্য পান; সমুদ্রগুপ্ত অন্য প্রকার বিজয় দ্বারা প্রাধান্য পান। তাঁর কাছে ধর্মবিজয়ের অর্থ অন্যরূপ ছিল। অশোক অহিংসা নীতিকে সার করেন; সমুদ্রগুপ্ত পরাক্রম অর্থাৎ “রক্ত ও লৌহ” নীতিকেই ন্যায্য বলে মনে করতেন। সমুদ্রগুপ্ত, অশোক অপেক্ষা কম প্রজাহিতৈষী ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন না। তবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মধারা ছিল ভিন্নতর।
Tags:
#Ancient
#গুপ্ত যুগ
#সমুদ্র গুপ্ত