ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও নারী শিক্ষা | অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায়

আরো - ধর্ম সংস্কার : ব্রাহ্ম আন্দোলন ও হিন্দু পুনরুজ্জীবন

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ছিলেন কলকাতার হিন্দু কলেজের শিক্ষক। তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর ছাত্রদের নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী বলা হতো। বিভিন্ন সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা মতামত প্রকাশ করেছিলেন। তাছাড়া জাতপাত, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি প্রথার বিরুদ্ধে তাঁরা সোচ্চার হয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন ও ইংরেজি শিক্ষার প্রতি নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর পুরো সমর্থন ছিল। পরবর্তীকালে ঐ গোষ্ঠীর অনেক সদস্যই নিজেদের পুরোনো মতামত ও অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিলেন।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে বাংলায় প্রায় একক উদ্যোগে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত কলেজে পড়ানোর সময় থেকেই শিক্ষা সংক্রান্ত নানান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। তাঁর উদ্যোগেই ব্রাক্ষ্মণ ও বৈদ্য পরিবারের ছেলেদের পাশাপাশি কায়স্থ ছেলেরাও সংস্কৃত কলেজে পড়ার সুযোগ পায়। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত শিক্ষার পাশাপাশি উপযুক্ত ইংরেজি শিক্ষার দরকারও অনুভব করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন মাতৃভাষা ও ইংরেজির মধ্যে সংযোগসাধন দরকার। ১৮৫০-এর দশকে ছাত্রদের পড়ার জন্য অনেকগুলি বই লেখেন বিদ্যাসাগর। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় লেখা আধুনিক গণিতের চর্চাও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। সহকারী স্কুল পরিদর্শক হিসেবে বাংলার বিভিন্ন জেলায় কয়েকটি মডেল স্কুল তৈরি করেন বিদ্যাসাগর। তিনি বুঝেছিলেন যে সরকারি তরফে যে সামান্য টাকা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়, তা " দিয়ে সমস্ত মানুষকে শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব নয়। ফলে শিক্ষা বিষয়ে ঔপনিবেশিক সরকারের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা উচিত বলে মনে করতেন বিদ্যাসাগর।

নারীদের শিক্ষাবিস্তারের প্রতিও বিদ্যাসাগর নজর দিয়েছিলেন। বেথুন স্কুলে যাতে মেয়েরা পড়তে যায় তার জন্য তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্কুল পরিদর্শকের কাজ করার সময় নিজের খরচে অনেকগুলি মেয়েদের স্কুল তৈরি করেছিলেন বিদ্যাসাগর। বাংলার বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা সেই স্কুলগুলিতে অনেক মেয়েই পড়াশুনা করত।

আরো - সতীদাহ প্রথা রদ ও বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন | অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায়

উনিশ শতকে নারীশিক্ষাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু নারীও উদ্যোগী হয়েছিলেন। এদের মধ্যে পশ্চিম ভারতে পণ্ডিতা রমাবাঈ, মাদ্রাজে ভগিনী শুভলক্ষ্মী ও বাংলায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে ব্রিটিশ প্রশাসন মেয়েদের শিক্ষার আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন অনুদান ও বৃত্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল । তার ফলে নারীশিক্ষার কিছুটা বিকাশ ঘটে।

পণ্ডিতা রমাবাঈ ছিলেন ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা ছিল। সমস্ত সামাজিক বাধা নস্যাৎ করে তিনি এক শূদ্রকে বিয়ে করেন। পরে বিধবা অবস্থায় নিজের মেয়েকে নিয়ে ইংল্যন্ডে গিয়ে ডাক্তারি পড়েন রমাবাঈ। বিধবা মহিলাদের জন্য তিনি একটি আশ্রম তৈরি করেছিলেন। তবে রমাবাঈয়ের উদ্যোগকে রক্ষণশীলদের অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন।

ডিরোজিও ছিলেন হিন্দু কলেজের ইংরাজি বিষয়ের তরুণ অধ্যাপক ও নব্যবঙ্গ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ৷ পর্তুগীজ বংশোদ্ভূত হলেও তিনি ভারতবর্ষকে মাতৃভূমি বলে মনে করতেন। প্রখর যুক্তিবাদী ও স্বাধীনচেতা ভিরজিও হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে ভারতীয় সমাজের সর্বপ্রকার অনাচার, দুর্নীতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক আন্দোলন গড়ে তোলেন যা বাংলার জন জীবনে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে।

হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র নেতৃত্বে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু কলেজের একদল তরুণ ছাত্র পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে হিন্দু ধর্ম ও সমাজে সকল কুসংস্কার, অনাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন যা নব্যবঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত।

নব্যবঙ্গ আন্দোলনের কয়েকজন নেতা হলেন— কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

ডিরোজিয়ান পন্থীদের কয়েকটি পত্রিকা হল ১। ‘জ্ঞানান্বেষণ', ‘এনকোয়ারার’, ‘হিন্দু পাইওনিয়র', 'ক্যালেইডেস্কোপ', 'বেঙ্গল স্পেকটেটর' প্রভৃতি।

ছাত্রদের মনে যুক্তিবাদী ও স্বাধীন চিন্তা বিকাশের উদ্দেশ্যে ১৮২৮ খ্রিঃ মানিকতলায় অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি বিতর্ক সভা প্রতিষ্ঠিত করেন। এটি ভারতের প্রথম ছাত্র সংগঠন নামে পরিচিত। যেখানে তার ছাত্ররা প্রচলিত অর্থনৈতিক সামাজিক রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কুসংস্কার, নৈতিক ভন্ডামি, জাতিভেদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করত। 'এথেনিয়াম' ছিল এদের মুখপত্র। উমেশ চন্দ্র বসু ছিলেন এর সম্পাদক।

স্ত্রী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে ১৮২৯ খ্রিঃ ডিরোজিও 'পার্থেনন' পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরিদর্শ পাচ্যবাদী পণ্ডিত উইলসন-এর সক্রিয় বিরোধিতার ফলে মাত্র দুটি সংখ্যা প্রকাশের পর এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।

নব্যবঙ্গ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি হল 

ক্ষণস্থায়ী হয়েও নব্যবঙ্গ আন্দোলনের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না—

১৮৫১ খ্রিঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

এদেশে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে—

বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধদয়, নীতিবোধ, চরিতাবলী, সংস্কৃত ব্যাকরণের ‘উপক্রমনিকা’ ও ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, ‘সীতার বনবাস’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি” প্রভৃতি।

নারী শিক্ষার বিস্তারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ১৮৪৯ খ্রিঃ ডিঙ্কওয়াটার বেথুন-এর সহযোগিতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়(বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। যেগুলির ব্যয় তিনি নিজে বহন করতেন। এছাড়া বীরসিংহ গ্রামে নিজ মাতা ভগবতী দেবীর নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

বিদ্যাসাগর ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্য ও আদর্শের সাথে পাশ্চাত্যের শিক্ষা, নারীপ্রগতি, সামাজিক চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন। তাই অমলেশ ত্রিপাঠী তাকে ঐতিহ্যবাদী আধুনিকতার প্রবক্তা বলে অভিহিত করেছেন।

বিদ্যাসাগর অলংকার সমন্বয় ও সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা ভাষাকে অনেক সরল ও সাবলীল করে তোলেন। যতি চিহ্নের ব্যবহার, বৃহৎ বাক্যকে ভেঙে কতকগুলি উপবাক্য তৈরী করার রীতি তাঁর অবদান, তাই ডঃ সুশীলকুমার দে তাঁকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রকৃত স্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।