অযোধ্যা ও ইংরেজের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল?

আঠারো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অযোধ্যা ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল না। বস্তুতপক্ষে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ অবধি ভারতে কোম্পানির কার্যকলাপ মূলত উপকূলীয় বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্যদিকে অযোধ্যা রাজ্যও দিল্লির সম্রাটকে প্রায় ক্রীড়নকে বানিয়ে প্রধান ক্ষমতাবান সুবা হিসাবে যথেষ্ট শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও অযোধ্যা রাজ্য মুখোমুখি সংঘাতে লিপ্ত হয়।
 
অযোধ্যার তৎকালীন নবাব সুজাউদ্দৌলা মুঘল সম্রাটের প্রতিনিধি হিসাবে বাংলার নবাব মিরকাশিমের সহযোগী হিসাবে কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হন। বক্সারের যুদ্ধে কোম্পানির প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে নিয়ে আসার জন্য ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন বা প্রয়োজনীয় অর্থ, রসদ, প্রশাসনিক কর্মচারী অথবা সেনাবাহিনী কোনওটাই ছিল না। অতএব একজন ‘অধীনস্থ মিত্রের’ মর্যাদা নিয়ে নবাব সুজাউদ্দৌলাকেই পুনরায় অযোধ্যার সিংহাসনে বসানো হয় ও ভবিষ্যতে মারাঠা বা আফগান শত্রুদের আক্রমণে অযোধ্যা রাজ্যকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হতে থাকে। অযোধ্যার বিপুল আর্থিক সম্পদকেও প্রয়োজন মতো কোম্পানির কাজে ব্যবহারের সুবিধা পাওয়া গেল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্তানুযায়ী অযোধ্যার কিয়দংশ কোম্পানি আত্মসাৎ করল ও বার্ষিক ৫০ লক্ষ টাকা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে অযোধ্যার বাকি অংশ নবাবকে প্রত্যার্পণ করা হলো। এ ছাড়াও, কোম্পানির প্রতি আনুগত্যের সূচক হিসাবে, এই চুক্তির দ্বারা নবাব তাঁর রাজ্যের প্রতিরক্ষার ভার এবং অযোধ্যায় বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার কোম্পানিকে দিয়ে দিলেন। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কোম্পানি অযোধ্যাকে এতটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল যে, ইউরোপীয় কায়দায় ও সজ্জায় নবাব তাঁর সেনাবাহিনীকে শিক্ষিত করে তুলতে চাইলে, কোম্পানি ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে আর একটি চুক্তি অযোধ্যার ওপর বলবৎ করে। এর বলে অযোধ্যার সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতম আয়তন ও সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়। ও তার এক-তৃতীয়াংশেরও কম সংখ্যাকে ইউরোপীয় কৌশলে শিক্ষিত করা যাবে—এই শর্ত চাপানো হয়। পুনরায় ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বেনারসের চুক্তির দ্বারা অযোধ্যার সেনাবাহিনীর আয়তন কমিয়ে তার এক অংশকে কোম্পানির অধীনস্থ সেনাবাহিনীতে (subsidiary force) পরিণত করা হয়; যার ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব চাপানো হয় অযোধ্যার ওপর। ক্রমশ, এই ভাবে অযোধ্যার অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে কোম্পানি হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে।

ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে কোম্পানির বিদেশ নীতিতে অযোধ্যাই ছিল মূল স্তম্ভ। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে চুক্তির ফলে সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখন্ড নিয়ে কোম্পানির সঙ্গে দর-কষাকষিতে প্রবৃত্ত হন।

অযোধ্যা-সুবার সুরক্ষাবলয়কে দৃঢ় করতে রোহিলাখন্ডকে গ্রাস করা দরকার, এই উপলব্ধিতে নবাব সুজাউদ্দৌলা ও কোম্পানি সহমত ছিল। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রোহিলা উপজাতির প্রধান হাফিজ রহমত খান, নবাব সুজাউদ্দৌলার সঙ্গে কোম্পানির প্রতিনিধি নবাব সুজাউদ্দৌলা সঙ্গে কোম্পানির প্রতিনিধি স্যার রবার্ট বার্কারের উপস্থিতিতে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এক শর্তানুসারে, রোহিলা ভূখণ্ড থেকে মারাঠা সৈন্যকে অপসারিত করতে পারলে, সুজাউদ্দৌলা রোহিলাদের কাছ থেকে ৪০ লক্ষ (চল্লিশ লক্ষ) টাকা পাবেন।

মারাঠা সৈন্য রোহিলাখন্ড ত্যাগ করেও ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় ফিরে আসে। কিন্তু পেশবা প্রথম মাধবরাও-এর মৃত্যুর পর দাক্ষিণাত্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মারাঠারা সেখানে ফিরে যায়। সুজাউদ্দৌলা এইবার রোহিলাদের কাছে চুক্তির শর্তমতো অর্থ দাবি করলে তারা তা দিতে অস্বীকার করে। অতএব ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বেনারসে সম্পাদিত কোম্পানি ও অযোধ্যার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্তানুযায়ী সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখন্ডের বিরুদ্ধে কোম্পানির সৈন্য সাহায্য দাবি করেন। এর বিনিময়ে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করা ছাড়াও তিনি কোম্পানিকে ৪০ লক্ষ টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কর্নেল চ্যাম্পিয়নের নেতৃত্বে কোম্পানির সৈন্য রোহিলাখন্ড আক্রমণ করে ও অযোধ্যা সেনাবাহিনীর সহায়তায় রোহিলা নেতা হাফিজ রহমত খানকে মিরানকাটরা-র যুদ্ধে নিহত করেন (এপ্রিল, ১৭৭৪)। রোহিলাখন্ড অযোধ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়।

রোহিলা-যুদ্ধের পিছনে অযোধ্যার নবাবের ব্যক্তিগত লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রবণতাকেই দায়ী করা হয়। ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথমে এই আগ্রাসনে সহযোগী থাকলেও খানিকটা দূরত্ব রেখে সুজাউদ্দৌলাকে সমর্থন দেন। সাময়িক ভাবে সুজাউদ্দৌলাও যুদ্ধে নিবৃত্ত থাকেন ও হেস্টিংসের সম্মতি পান। কিন্তু ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে নবাব পুনরায় হেস্টিংসের উপর চাপ দিলে অবশেষে কোম্পানির সৈন্য রোহিলাখন্ড আক্রমণ করে।

এই আগ্রাসন যে ভাবে বিনা প্ররোচনায় রোহিলাদের বিরুদ্ধের পরিচালিত হয়েছিল ও নবাব যে সুকৌশলে কোম্পানির সৈন্যকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন তার জন্যই ওয়ারেন হেস্টিংসকে কূটনৈতিক ব্যর্থতার জন্য সমালোচিত হতে হয়।

অতএব, ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীতে অযোধ্যার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্ত হাতে পরিচালিত করতে কোম্পানি একজন রেসিডেন্ট নিয়োগ করে। ক্রমশ, কোম্পানি ও নবাবের মধ্যে যাবতীয় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় এই রেসিডেন্ট। প্রকৃতপক্ষে অযোধ্যা রাজ্যের যাবতীয় আর্থিক ও বৈদেশিক নীতি পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণের ভার চলে যায় রেসিডেন্টের হাতে। ভারতের অন্যান্য দেশীয় রাজ্যের ক্ষেত্রেও এই পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ কায়েমের পরম্পরায় প্রথম দৃষ্টান্ত হয় অযোধ্যা। সুজাউদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর অযোধ্যা কোনও রকমে মুঘল সুবার পরিচয়টুকু টিকিয়ে রেখে ক্রমশই কোম্পানির দখলে চলে যায়।

নতুন নবাব আসফউদ্দৌলার আমলে, ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে লখনউ হয় অযোধ্যা রাজ্যের নতুন রাজধানী। এক দিকে উত্তর ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় রাজ্য হিসাবে অযোধ্যা কোম্পানির কাছে জরুরি কেন্দ্র হয়ে ওঠে, অন্যদিকে তার সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কোম্পানির নিয়মিত সৈন্যদের সরিয়ে একটি স্বতন্ত্র Oudh Auxiliary Force বা একটি ভাড়াটে বাহিনী তৈরি করা হয়, যার পুরো ব্যয়ভারই অযোধ্যার তহবিল থেকে কাটা যাবে স্থির করা হয়। এর পরোক্ষ ফল হলো, নবাবের নিজস্ব সৈন্যবাহিনীকে অব্যবহৃত রেখে ক্রমশ অকেজো করে দেওয়া।

আসফউদ্দৌলা-র মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যা অযোধ্যাকে আরও দুর্বল করে তোলে। প্রথম দিকে ক্ষমতার অন্যতম দাবিদার ওয়াজিব আলিকে (১৭৯৭–৯৮) সমর্থন জানালেও তাঁর স্বাধীনতা স্বাধীনচেতা মনোভাব কোম্পানিকে অসন্তুষ্ট করে। ফলে দীর্ঘ ২২ বছর কোম্পানির আশ্রয়ে রাজনৈতিক ভাবে নির্বাসিত থাকা সাদাত আলি খানকে কোম্পানি সিংহাসনে বসায়।

এই ক্ষমতা লেনদেনের ব্যবসায়ে কোম্পানি আর্থিক ভাবে আরও লাভবান হয়। আরও রাজ্যাংশ গ্রাস করা ছাড়াও কোম্পানি তার রেসিডেন্টের মাধ্যমে অযোধ্যার বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপেও দখলদারির হাত বসাল। বিশেষত, যুদ্ধের প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ তৈরির কাঁচামাল সোরা (saltpeter), বিভিন্ন হস্তশিল্প যেমন বস্ত্র ও অন্যান্য শৌখিন সামগ্রী, বাদ্য ও বিবিধ পণ্যশস্য যেমন নীল উৎপাদন—যা ব্রিটেনের বস্ত্রশিল্পের জন্য দরকার ছিল—এ সবই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে এল। এ ছাড়াও নগদ অর্থ, যা অযোধ্যার ভূখণ্ডে অবস্থিত কোম্পানির পোষ্য সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ বাবদ তারা আদায় করত; কিংবা স্বল্প সুদে কোম্পানির ঋণ গ্রহণ, কিংবা নবাবের তরফে কোম্পানির তহবিলে (বাধ্যতামূলক) সরকারি বা বেসরকারি ভাবে দেয় দান (donation) – বিভিন্ন প্রকারে অযোধ্যা কোম্পানির তহবিলে অর্থদানে বাধা হয়। ১৭৬৪ থেকে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানি কেবল জরিমানা বাবাদ ৬০,০০,০০০ টাকা; ঋণ বাবদ ৫২,০০,০০০ টাকা ও ভর্তুকি বাবদ ৮০,০০,০০০ থেকে শুরু করে ১০০,০০০, ০০০ টাকা আদায় করে।

এতদ্‌সত্ত্বেও নবাব সাদাত আলি খান অযোধ্যার প্রশাসনে স্বনির্ভরতা ও স্বাধিকার ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হলে নতুন গভর্নর জেনারেল ওয়েলেসলি (১৭৯৮-১৮০৫) কোম্পানির আগ্রাসী ভূমিকাকে তীব্রতর করেন। তাঁর রেসিডেন্টের মাধ্যমে অযোধ্যার অন্তর্ভুক্ত গোরক্ষপুর ও রোহিলাখন্ড এবং দোয়াবের কিছু উর্বর এলাকা প্রত্যক্ষ ভাবে কোম্পানির এলাকাভুক্ত করেন। এ ছাড়াও তিনি অযোধ্যার আভ্যন্তরীণ প্রশাসনে সংস্কারের দাবি জানান। সাদাত আলি খান কোম্পানির আর্থিক দাবিদাওয়া পূরণ করলেও রাজ্যের আভ্যন্তরীণ প্রশাসনে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন। অতএব লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের এক নতুন চুক্তি দ্বারা অযোধ্যার সীমার বাইরে যাবতীয় ভূখণ্ড, যার বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১৩,০০০,০০০ টাকা, কোম্পানির সেনাবাহিনীর চিরস্থায়ী ভাতা হিসাবে অধিকার করে নেওয়া হলো। কোম্পানির দখলিকৃত এলাকা চতুর্দিক দিয়ে অযোধ্যাকে ঘিরে রইল। অযোধ্যাকে ‘কুশাসনের' একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরে কোম্পানি তার ভূসম্পদ, বাণিজ্য, শ্রমসম্পদ ও অর্থসম্পদ—সব দিকেই শোষণের জাল বিস্তার করে। পরবর্তী নবাব গাজিউদ্দিন হায়দারের আমলেও (১৮১৪-২৭) ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির নেতৃত্বে অযোধ্যা গ্রাসের চক্রান্ত বহাল থাকে।
Tags:
Next Post Previous Post